মুম্বাই শহরের বুকে হঠাৎই ভিড় করে এসে দাঁড়িয়েছে ১৫১টি গরুর গাড়ি। আর প্রতিটা গাড়ি মানুষের ভিড়ে বোঝাই। সেখানে বসে বসে ঢোল বাজাচ্ছেন কেউ কেউ। অবশ্য কারণটা বুঝতে বেশি সময় লাগেনি কারোরই। কারণ কিছুক্ষণ পরেই যে মানুষটি এসে তাঁদের সঙ্গে যোগ দিলেন, তাঁকে দেখতে অনেক জায়গা থেকেই মানুষ ভিড় করেছেন। খোদ মহারাষ্ট্রের মুখ্যমন্ত্রী দাঁড়িয়ে আছেন মালা হাতে। কার জন্য? তিনি আর কেউ নন, খাসব যাদব।
কে এই খাসব যাদব? নামটা অনেকের কাছেই হয়তো অপরিচিত। কিন্তু এই মানুষটাই আন্তর্জাতিক ক্রীড়া জগতে ভারতের নাম তুলে এনেছিলেন প্রথম সারিতে। অলিম্পিকের প্রথম একক পদকজয়ী ভারতীয় খাসব যাদব। ১৯৫২ সালের হেলসিঙ্কি অলিম্পিকের ব্রোঞ্জ পদকজয়ী কুস্তিবীর খাসব। অবশ্য এর আগে ১৯৪৮ সালেই ভারতের হকি দল অলিম্পিকে সোনা জয় করেছে। পরাধীন ভারতবর্ষেও নানা সময়ে হকি, কুস্তি এবং সাঁতারের দল অলিম্পিকে পদক জয় করেছে। তবে এককভাবে কোনো খেলোয়াড় পদক জয় করতে পারেননি।
খাসবের এই যাত্রাপথ অবশ্য সহজ ছিল না। ১৯৪৮ সালে স্বাধীন ভারতের প্রথম অলিম্পিক দল রওয়ানা হল লন্ডনের উদ্দেশ্যে। সেই দলেই কোনোরকমে জায়গা করে নিলেন খাসব। কিন্তু কীভাবে লন্ডন অবধি পৌঁছবেন তিনি? তখন খেলোয়াড়দের অলিম্পিকের ময়দানে পৌঁছনোর জন্য কোনোরকম আর্থিক সাহায্য সরকারের পক্ষ থেকে পাওয়া যেত না। নানা চেষ্টা করে, বন্ধুদের থেকে টাকা ধার নিয়ে পৌঁছলেন লন্ডনে। তবে তিনটি ম্যাচের পরেই বাদ পড়লেন প্রতিযোগিতা থেকে। সেবার ৬ নম্বর স্থানে জায়গা পেলেন খাসব।
সেবার ফিরে এসেই পরবর্তী অলিম্পিকের জন্য প্রস্তুতি শুরু করলেন খাসব। ৪ বছরের প্রস্তুতির শেষে তিনি নিজে যখন রীতিমতো আত্মবিশ্বাসী, তখনই নানা স্তর থেকে শুরু হল কুৎসিত রাজনীতি। যেকোনো প্রকারেই হোক, খাসবকে অলিম্পিকে অংশগ্রহণ করা থেকে আটকাতে হবে। প্রস্তুতি ম্যাচে অনৈতিকভাবে হারিয়ে দেওয়া হল তাঁকে। তবে মহারাষ্ট্রের অন্যান্য খেলোয়াড়রা পাশে না দাঁড়ালেও সেদিন এগিয়ে এসেছিলেন পাঞ্জাব এবং পশ্চিমবঙ্গের কুস্তিবীররা। নতুন করে প্রস্তুতি ম্যাচের আয়োজন করা হল কলকাতায়। কিন্তু প্রশাসনিকভাবে সুযোগ পেলেও আবারও সমস্যা হয়ে দাঁড়াল যাতায়াতের খরচ।
আরও পড়ুন
বরানগরের অতনুর হাত ধরেই অলিম্পিকে পদকের স্বপ্ন দেখছে ভারত
ফিনল্যান্ড পৌঁছনোর জন্য নিজের জমি-বাড়িও বিক্রি করলেন খাসব। কিন্ত তারপরেও প্রায় ১ লক্ষ টাকার প্রয়োজন। শেষ পর্যন্ত মুখ্যমন্ত্রী মোরারজি দেশাইয়ের কাছে আবেদন জানালেন তিনি। সেখান থেকেও কোনো ইতিবাচক সাড়া এল না। শেষ পর্যন্ত গোলেশ্বর গ্রামের সমস্ত বাসিন্দারা নিজেদের সাধ্যমতো সাহায্য তুলে দিলেন খাসবের হাতে। তিনি হেলনিসকি শহরে পৌঁছলেন। এবং অলিম্পিক জয়ও করলেন।
আরও পড়ুন
প্রয়াত কোভিডযোদ্ধাদের সম্মান জানাতে বিশেষ মেমোরিয়াল নলবনে
সেই বছরও অবশ্য ভারতের হকি দল সোনা জয় করেছিল। কিন্তু ভারতের কাছে অলিম্পিক আইকন হয়ে উঠলেন খাসব। কারণ তিনি নিজের একক চেষ্টায় পদক জয় করেছেন। এরপর ভারতের দ্বিতীয় একক পদক পেতে সময় লেগেছিল আরও ৪৪ বছর। ১৯৯৬ সালে লিয়েন্ডার পেজের হাত ধরে এসেছিল সেই পুরস্কার। স্বাভাবিকভাবেই খাসব যে কিংবদন্তি হয়ে উঠবেন, তাতে সন্দেহ নেই। কিন্তু ভারতের মাটিতে যে কিংবদন্তিরাও সবসময় যোগ্য সম্মান পান না, খাসব নিজেই তার প্রমাণ।
আরও পড়ুন
ছকভাঙা তথ্যচিত্রে মহারাষ্ট্রের লোককথা, আন্তর্জাতিক সম্মাননা বাঙালি পরিচালকের
১৯৫৫ সালে পুলিশবিভাগে কনস্টেবল পদে যোগ দিয়েছিলেন খাসব। ১৯৮২ সালে অ্যাসিস্টেন্ট কমিশনার পদ থেকে অবসর গ্রহণ করেন। কিন্তু এরপরেই শুরু হয় আরও কঠিন জীবন। অবসর গ্রহণের পর নূন্যতম পেনশনের টাকাটুকুও পাননি খাসব। এদিকে নিজের সমস্ত সঞ্চয় আগেই খরচ করে দিয়েছেন অলিম্পিকে অংশগ্রহণের জন্য। চাকরি করে যেটুকু অর্থ হাতে থাকত, তা খরচ করতেন গ্রামের খেলাধুলোর পরিকাঠামো তৈরির কাজে। কপর্দকশূন্য খাসব সরকারি কর্তাদের কাছে বারবার ছুটে গিয়েছেন। কিন্তু কোনো ফল হয়নি। ১৯৮৪ সালে হঠাৎই এক দুর্ঘটনায় প্রাণ হারালেন কিংবদন্তি এই কুস্তিবীর। তাঁর মৃত্যুর পরেও টনক নড়েনি সরকারের। সংসারের হাল ধরতে একমাত্র ছেলেকে পড়াশোনা থামিয়ে দিয়ে কৃষিকাজ শুরু করতে হয়।
এরপর অবশ্য মরণোত্তর ছত্রপতি পুরস্কার, মরণোত্তর অর্জুন পুরস্কার পেয়েছেন তিনি। কিন্তু জীবদ্দশায় শুধুই অবহেলা আর লাঞ্ছনা সহ্য করে গেলেন। আজও কি যোগ্য সম্মান পেয়েছেন তিনি? দেশের কজন মানুষই বা মনে রেখেছেন এই একক নায়ককে?
Powered by Froala Editor