ক্রিকেট নিয়ে মশগুল ভারতে কিছুদিনের জন্য খেলার পাতা থেকে মিডিয়া কিংবা সোশ্যাল মিডিয়ায় কিছু অন্য খেলার খবরের দেখা মিলবে। অন্তত কিছুদিনের জন্য। কারণ চিনে শুরু হয়ে গেল এশিয়ান গেমস (Asian Games)। আনুষ্ঠানিক উদ্বোধনের আগে ১৯ সেপ্টেম্বর ভারতীয় পুরুষ ফুটবল দল খেলতে নেমে পড়ল আয়োজক দেশ চিনের বিরুদ্ধে। নানা টানাপোড়েন পেরিয়ে অবশেষে ফুটবল দলের ছাড়পত্র মিলেছে গেমসে খেলার। যদিও শুরুটা ভালো হয়নি। ১-৫ গোলে হেরে এশিয়ান গেমস যাত্রা শুরু হয়েছে সুনীল ছেত্রীদের। তবে ফুটবলের বাইরেও অন্যান্য টিম গেমে ভারতীয় দলের অংশগ্রহণ কিন্তু বেশ গুরুত্বপূর্ণ। এরমধ্যে অন্যতম রাগবি (Rugby)। হ্যাঁ ঠিক শুনেছেন। রাগবি।
কিন্তু এই ক্রিকেটের দেশে রাগবি? তাও আবার মেয়েরা খেলবে? নৈব নৈব চ। কিন্তু মেয়েরা একগুঁয়ে হলে সবই সম্ভব। পিছন থেকেও সামনে আসা যায়। সেটাই করে দেখিয়েছে ভারতীয় মহিলা রাগবি দল (Indian Women's Rugby Team)। তারা এবার যোগ দেবে এশিয়ান গেমসে।
২৩ সেপ্টেম্বর থেকে চিনের ঝেজিয়াং প্রদেশের হ্যাংঝোতে শুরু এশিয়ান গেমসের ১৯তম সংস্করণ। ভারতীয় মহিলা রাগবি দল এই প্রতিযোগিতায় ইতিমধ্যেই যোগ্যতা অর্জন করেছে। আরেকটি চমকপ্রদ তথ্য, এশিয়ান দেশ হিসাবে সপ্তম স্থানের অধিকারী এই ভারতীয় মহিলা রাগবি টিম। গত কয়েক বছরে মেয়েদের রাগবি দলের দৌড়টাও চোখে পড়ার মতো। ভারতীয় রাগবির জন্য এটা অবশ্যই এক মাইলফলক। কী থেকে তাঁরা অনুপ্রেরণা পেলেন? কী এমন ঘটল, যাতে ভারতীয় মহিলা রাগবি দলকে এশিয়ার সবচেয়ে বড় ক্রীড়া মঞ্চে দক্ষতা প্রদর্শন করতে দেখা যাবে?
এশিয়ান গেমসের আগে, রাগবি দল কলকাতায় স্পোর্টস অথরিটি অফ ইন্ডিয়া (SAI) ক্যাম্পাসে অনুশীলন জারি রাখে। ক্যাম্পের পর ১২ জন খেলোয়াড়কে শর্টলিস্ট করা হয়। বড় আয়োজনের আগে চূড়ান্ত প্রস্তুতিও চলে পুরোদমে। তবে সহজ ছিল না এই পথ। গ্রামে গ্রামে গিয়ে খেলোয়াড় বাছাইয়ের সিদ্ধান্ত নিয়েছিল ভারতীয় রাগবি ফুটবল ইউনিয়ন। এক্ষেত্রে বহু কাঠখড় পোড়াতে হয় তাদের। দুর্বল অর্থনৈতিক পটভূমি, রক্ষণশীল পরিবারের চাপরাস তো একপ্রকার অন্তরায়ই।
আরও পড়ুন
দারিদ্রকে হারিয়ে রাগবির ময়দানে বাংলার তরুণীরা
দলের কোচ লুডউইচ ভ্যান ডেভেন্টার ছিলেন নাছোড়। তাঁর জন্ম দক্ষিণ আফ্রিকায়। ডেভেন্টারের অধীনে মহিলা রাগবি দল দারুণ উন্নতি করে। ভারতীয় রাগবি ফুটবল ইউনিয়নের সভাপতি রাহুল বোসের ভূমিকাও কম নয়। তাঁর নখদর্পণে থাকত গোটা প্রক্রিয়া।
আরও পড়ুন
মহিলাদের রাগবি খেলায় উৎসাহ দিতে প্রচারের মুখ উত্তরবঙ্গের সন্ধ্যা
কেওনঝাড়ের বাসিন্দা তরুলতা নায়েক। রাগবির সঙ্গে পরিচয় স্কুলে পড়ার সময় থেকে। বেশ কয়েক বছর আগের কথা। সেদিন তিনি দর্শক। প্রবল উৎসাহ নিয়ে দেখছিলেন কোনো রাগবি ম্যাচ। গ্রাম ছানবিনের দায়িত্ব নিয়ে কোচ ডেভেন্টার সেদিন সেখানেই। তরুলতাকে দেখতে পেয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, রাগবি খেলবে? রাজি হয়ে যান তরু। এহেন তরু আজ দেশের প্রতিনিধিত্বকারী সিনিয়র মহিলা দলের অংশও। উপজাতীয় পটভূমি থেকে উঠে আসায় সমাজ থেকে অনেক স্টিরিওটাইপের মুখোমুখিও হতে হয় তাঁকে। এক সর্বভারতীয় সংবাদমাধ্যমকে তরুলতা বলেন, ‘আমার পরিবার শুধু চেয়েছিল আমি পড়াশোনা করি। কিন্তু স্কুল থেকেই আমি রাগবি খেলতে শুরু করি ২০১৬ সালে। এশিয়ান গেমস ২০২৩-এ সোনার স্বপ্নে বুঁদ আমরা।’
শ্বেতা শাহীর গল্পও অনুপ্রেরণাদায়ক। অনুশীলনে কখনো গরম বালির উপর হেঁটেছেন। তাপে ফোসকা পড়েছে পায়ে। ঘাম ঝরিয়েছেন। তবে ক্লান্ত হলেও হাল ছাড়েননি। রক্ত-ঘাম পায়ে ফেলেই সাফল্যের সোপানে চড়েছেন। ১৯ বছর বয়সি শ্বেতা শাহীর সাফল্যের একটি গল্প আছে। শ্বেতা ইউটিউবে ভিডিয়ো দেখে রাগবি খেলা শিখেছেন। ইন্টারনেটই তাঁর প্রথম কোচ। শ্বেতার উঠে আসাও বিহারের এক রক্ষণশীল পরিবার থেকে। তাঁকে নিয়েও বাঁধাধরা ভাবনা ছিল পরিবারের। যদিও সেসবকে বুড়ো আঙুল দেখিয়েই শ্বেতার উঠে আসা। এখান থেকেই শ্রীলঙ্কা, দুবাই এবং দক্ষিণ কোরিয়ায় অনুষ্ঠিত এশিয়ান রাগবি সেভেনস সিরিজে ভারতীয় দলের অবিচ্ছেদ্য অংশ হওয়া। এশিয়ান গেমসেও ভালো খেলার প্রত্যাশা রয়েছে শ্বেতার।
এশিয়ান গেমসের প্রস্তুতির সময় ইন্ডিয়া টুডে-আজ তকের সঙ্গে কথা বলার সময় তিনি বলেন, ‘বাবার কাছ থেকে প্রচুর সমর্থন পেয়েছি। আমি রাগবি শেখার জন্য অনেক ভিডিয়ো দেখেছি। সেসব বাবাকেও দেখাতাম। যেখানেই যেতাম, বাবা সঙ্গে যেতেন। তখন আমাদের আর্থিক সমস্যা ছিল। আমার গ্রামের মেয়েরা পড়াশোনা করতেও বাইরে যায় না। সেই গ্রামে আমি খেলাধুলা করতাম। বুঝতেই পারছেন! নিন্দুকরা বাবাকেও ছাড়েনি। কটু কথা শুনিয়েছে। আমার পরিবারকেও নানান অপমান সামলাতে হয়েছে। সবকিছু ভুলে আমরা এশিয়ান গেমসে আমাদের সেরাটা দিতে চাই।’
হুপি মাঝির বয়স যখন আট, ভুবনেশ্বরের বোর্ডিং স্কুলে পাঠানো হয়। সেখানকার অজানা জীবনের কথা ভেবে ভয় পেয়ে গিয়েছিল সে। বাড়ি থেকে এত দূর যাওয়া সেটাই প্রথমবার। কেওনঝাড় জেলা সদরের উত্তরে ধাটিকার নাম ছোট্ট এক গ্রামে বেড়ে ওঠা হুপির বেড়ে ওঠা পরিবারের কঠোর শৃঙ্খলে। মেয়ে হয়ে জন্ম, তাই তোমাকে থাকতে হবে অন্দরমহলেই। এমন সংস্কারের আবহে বড় হওয়া হুপি এখন ভারতীয় দলের অন্যতম সদস্য। সাঁওতাল পটভূমি থেকে উঠে আসা হুপির লড়াইটা কিন্তু মসৃণ ছিল না। সাক্ষাৎকারে হুপি বলেছেন, 'আমার হাফপ্যান্ট পরায় আপত্তি ছিল গ্রামের লোকজনের। তারা বলেছিল, তুই তো মেয়ে, খেলবি কেন? মেয়েরা তো খেলে না। এমন বহু কিছুরই মুখোমুখি হয়েছি। কিন্তু আমি খেলতে চেয়েছিলাম এবং সেটাই করেছি। আমার দিদি-জামাইবাবু সবসময় আমার পাশে দাঁড়িয়েছেন। এশিয়ান গেমসে দেশকে একশো ভাগ দিতে চাই। এটি আমাদের জন্য একটি বড় সুযোগ। সেখানে আমরা অন্যান্য দেশের সঙ্গে খেলে অভিজ্ঞতা অর্জন করতে পারব।’
ক্যাপ্টেন শীতল শর্মার উঠে আসা অ্যাথলেটিক ব্যাকগ্রাউন্ড থেকে। গত ৮ বছর ধরে চুটিয়ে রাগবি খেলছেন। এর মধ্যে টানা পাঁচ বছর ধরে এশিয়ান কন্টিনজেন্টে দেশের প্রতিনিধিত্ব করছেন। আত্মবিশ্বাসী শীতল বলেন, 'আমার অনেক দায়িত্ব। দলের পূর্ণ সমর্থন রয়েছে। প্রত্যেক সদস্য খুবই সক্রিয়। আমাদের দল একটি ইউনিট। একটি ইউনিট হিসাবেই লড়াই করব। আমরা একটি এক্সপোজার ট্যুরও করেছি। বাবা মারা যাওয়ার পর বহু চড়াই-উতরাইয়ের শিকার আমি। তবে সবসময় পরিবারের সমর্থন পাই। সরকার, কোচ, আমাদের রাগবি ইউনিয়ন; কেউই আমাদের পদকের জন্য কখনো চাপ দেয়নি। আমরা আত্মবিশ্বাসী। এশিয়ান গেমসের জন্য মাঠে ১০০ শতাংশ দিতে চাই।’
চা-বাগানের শ্রমিক পরিবারের কন্যা পশ্চিমবঙ্গের সন্ধ্যা রাই ভারতীয় মহিলা রাগবি দলের সহ-অধিনায়ক। তবে, বহু চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়েছেন। শুনতে হয়েছে কটূক্তি। সন্ধ্যার বাবা-মা শিলিগুড়ির বৈকুণ্ঠপুর বনের সরস্বতী চা-বাগানের শ্রমিক। সন্ধ্যা আলাপচারিতায় জানান, 'আমি পশ্চিমবঙ্গের জলপাইগুড়ির একটি ছোট গ্রামের একটি চা-বাগান থেকে উঠে এসেছি। আমার পরিবারের সমর্থন পেয়েছি সবসময়। এখন পর্যন্ত অসাধারণ ছিল আমাদের জার্নি। আমরা চিন ও জাপানের বিপক্ষে খেলব। এই কারণে আমরা উত্তেজিত এবং একইসঙ্গে নার্ভাসও। আমাদের মনোযোগ পদকের জন্য।’ আরেকটা কথা, আজ সন্ধ্যার জন্য বদলে গিয়েছে আস্ত একটা গ্রাম। জলপাইগুড়ি জেলার প্রত্যন্ত গ্রামটি বাংলা তো বটেই, দেশের ক্রীড়া মানচিত্রে নতুন করে জায়গা করে নিয়েছে। ২০১৩ সাল। সন্ধ্যা রাগবির সঙ্গে প্রথম পরিচিত হন ১৩ বছর বয়সে। ২০১৫ সালে এই গ্রাম থেকে জায়গা করে নিয়েছিলেন বাংলা দলে। ২০১৭ সালে জাতীয় অনূর্ধ্ব-১৮ দলের হয়ে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে অভিষেক ঘটে প্যারিসে। দুর্দান্ত বিষয় হল, সঙ্গে সরস্বতীপুরের আরোও সন্ধ্যার সঙ্গে সেই দলে সুযোগ পেয়েছিলেন ওই গ্রামেরই পাঁচজন। এশিয়ান ১৫’স রাগবি ২০১৭, এশিয়া সেভেনস ২০১৯, অনূর্ধ্ব-২০ এশিয়া সেভেনস ২০১৯ সহ আমেরিকা, জাপানের মাটিতে খেলেছেন এই অদিবাসী কন্যা।
মহারাষ্ট্রের কল্যাণী পাতিলের বাবা একজন নিরাপত্তারক্ষী। স্কুলে পড়ার সময়েই রাগবিতে হাতেখড়ি তাঁর। কল্যাণী বলেন, 'সবসময় পরিবারকে পাশে পেয়েছি। কিন্তু আশপাশের লোকজন সবসময় আমাকে নিয়ে বাঁকা মন্তব্য করেছে। বলেছে মেয়েরা খেলতে পারে না, হাফপ্যান্ট পরতে পারে না। আমার পরিবার এবং স্যার সবসময় আমাকে সমর্থন জুগিয়ে গেছেন। আমার বাবা একজন নিরাপত্তারক্ষী বলে প্রথম দিকে অনেক সমস্যা হয়েছিল। যাই হোক, এশিয়ান গেমসে ভালো খেলার লক্ষ্য নিয়ে আছি।’
ভারতীয় মহিলা রাগবি দল
শীতল শর্মা (ক্যাপ্টেন), সন্ধ্যা রাই (ভাইস ক্যাপ্টেন), শ্বেতা শাহী, মামা নায়েক, কল্যাণী পাতিল, বৈষ্ণবী পাতিল, লছমি ওরাওঁ, ডুমুনি মার্ন্ডি, হুপি মাঝি, শিখা যাদব, তরুলতা নায়েক, এবং প্রিয়া বনসাল।
চিত্রঋণ : রাগবি ইন্ডিয়ার ইনস্টাগ্রাম হ্যান্ডেল
Powered by Froala Editor