ম্যাচের শুরু থেকেই যেন এক অঘটনের পূর্বাভাস পাওয়া গিয়েছিল। একদিকে তিনবারের সোনাজয়ী প্রবল প্রতিদ্বন্দ্বী আজি বাহিনী। অন্যদিকে ভারতের মহিলা দল। অলিম্পিকে কোনোদিন পদকজয়ের সৌভাগ্য হয়নি ভারতের মহিলা হকি দলের। কারোর প্রত্যাশাও ছিল না। অথচ কোয়ার্টার ফাইনালের শুরু থেকেই স্বপ্রভ রানি রামপালের বাহিনী। নিজের গোলপোস্ট রক্ষা নয়, বরং বারবার অস্ট্রেলিয়ার বক্সে ঢুকে আক্রমণ শানাতে থাকে রানি বাহিনী। প্রথম কোয়ার্টার গোলশূন্য থাকলেও দ্বিতীয় কোয়ার্টারের শুরুতেই এগিয়ে যায় ভারত। পেনাল্টি কর্ণার থেকে নির্ভুল গোল গুরজিৎ কৌরের।
অলিম্পিক মানেই অঘটনের আসর। আর এবারের অলিম্পিকে তার ঘনঘটা যেন আরও খানিকটা বেশি। তবে সমস্ত অঘটনকে ছাপিয়ে যায় ভারতের মহিলা হকি দলের ফাইনালে ওঠা। এমনটাই মনে করছেন অনেকে। এ যেন অঘটনেরও অঘটন। ১৯৮০ সালে অলিম্পিকে মহিলাদের হকি খেলার শুরু। প্রথমদিকে ভারতীয় দলের খেলার প্রশংসাও করতেন অনেকে। কিন্তু পদকজয়ের সৌভাগ্য হয়নি কোনোদিনই। আর চলতি অলিম্পিকে? প্রথম থেকেই পরাজয় দিয়ে যাত্রা শুরু ভারতের। প্রথম ম্যাচেই নেদারল্যান্ডসের কাছে ১-৫ গোলে পর্যুদস্ত হল রানি বাহিনী। এরপর জার্মানি ও গ্রেট ব্রিটেনের কাছে চূড়ান্ত হার। তবু অলিম্পিক মানেই যে অনিশ্চয়তা। এরপর আয়ারল্যান্ড এবং দক্ষিণ আফ্রিকাকে হারায় ভারত। কিন্তু কোয়ালিফিকেশন রাউন্ড পেরনো তখনও অনিশ্চিত। অবশেষে গ্রেট ব্রিটেনের কাছে আয়ারল্যান্ড পর্যুদস্ত হওয়ায় নক-আউট রাউন্ডে খেলা নিশ্চিত হল।
এভাবে মার্জিনের গা দিয়ে কোয়ালিফিকেশন রাউন্ড পেরিয়ে যাওয়া একটা দল যে আবার মাথা তুলে দাঁড়াতে পারবে, এমনটা কল্পনা করাও কঠিন। ভারতের সমর্থকরাও এমনটা আশা করেননি। পদকজয়ের জন্য নয়, নিছক নিজেদের যোগ্যতা প্রমাণের তাগিদেই খেলা শুরু ভারতের মহিলা শিবিরের। সমস্ত দুঃশ্চিন্তা ভুলে লক্ষ্য একটাই, নিজেদের সবটুকু দিয়ে লড়াই করা। দ্বিতীয় কোয়ার্টারের শুরুতেই এগিয়ে যাওয়ার পরেও খেলায় কোনো শ্লথতা দেখা যায়নি। ডিফেন্সের চেষ্টা না করে শেষ পর্যন্ত আক্রমণাত্মক ভঙ্গিতে খেলা চালিয়ে যান ভারতীয়রা। অন্যদিকে অস্ট্রেলিয়া একটি পেনাল্টির সুযোগ পেলেও ভারতের গোলকিপার সবিতা পুনিয়া ও দলের বাকিরা রুখে দেন সেই প্রয়াস। শেষ পর্যন্ত স্কোরবোর্ডে আর কোনো পরিবর্তন দেখা যায় না।
পুরুষ হকি দলের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে অবাক করে চলেছেন ভারতের মহিলারা। অবশ্য হকির ইতিহাসে ভারতের সাফল্য নতুন নয়। বিগত কয়েকটা অলিম্পিকে খারাপ খেললেও ভারতের পুরুষ হকি দলের কাছে অলিম্পিকে সোনা জেতা ছিল এক সময়ে অতি স্বাভাবিক ঘটনা। মহিলা হকিতে ভারত কোনোদিন অলিম্পিকে কোনো পদক পায়নি। এমনকি সেমিফাইনালেও উঠতে পারেনি কোনোদিন। কিন্তু এশিয়ান গেমসে ১৯৮২ সালে সোনা জেতে ভারতের মহিলা হকি দল। ১৯৯৮ আর ২০১৮-তে রুপো জয়। ১৯৮৬, ২০০৬, ২০১৪-তে ব্রোঞ্জজয়। এশিয়া কাপেও দুবারের চ্যাম্পিয়ন এবং দুবারের রানার্স-আপ ভারতের মহিলা হকি দল। কিন্তু অলিম্পিকের পদকজয়ের সমতুল্য কোনো সাফল্য এতদিন অধরাই ছিল। প্রথম সেমিফাইনালে পা রাখার মধ্যে দিয়ে সেই সম্ভাবনাই জোরদার করে তুলল রানি বাহিনী। তবে যে অলিম্পিকের শুরুতেই ধাক্কা খেতে হয় আমেরিকার মহিলা ফুটবল দলকে, টেবিল টেনিসে নিশ্চিত সোনা জেতার দৌড় থেকে ছিটকে জেতে হয় চিনকে, এমনকি সবাইকে অবাক করে দিয়ে ১২৫ বছর পর অস্ট্রিয়ার সাইকেল রেসে সোনা জেতার নেপথ্যে থাকেন একজন আদ্যন্ত গণিতের অধ্যাপক – সেখানে কোনটা কতটা বড়ো অঘটন তা ঠিক করা কঠিন। তবে আজ সকাল পর্যন্তও অনেকে মনে করছিলেন, বিশ্বরেকর্ডজয়ী সাঁতারু কেটি লেডিকির সোনা না পাওয়াই বুঝি সবচেয়ে বড়ো অঘটন। তাকেও পিছনে ফেলে দিল ভারতের মহিলা হকি দল। অবশ্য এখনও সেমিফাইনাল এবং ফাইনাল বাকি। পদকজয় নিশ্চিত নয় এখনও। তবে সমস্ত সম্ভাবনার সমীকরণ ওলোটপালট করে দেওয়া এই সাফল্যকে বোধহয় পদকের বিচারে মাপাও যায় না।
Powered by Froala Editor