স্বাধীনতার পরেও প্রায় তিন বছর ‘ব্রিটিশ শাসন’ জারি ছিল ভারতে!

“রাত বারোটায় গোটা পৃথিবী যখন ঘুমিয়ে থাকবে, ভারত তখন স্বাধীনতা ও নতুন জীবনের স্বপ্ন নিয়ে জেগে উঠবে।” আজও এই দেশের ইতিহাসের সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে এই কথাটি। ১৯৪৭ সালের ১৫ আগস্ট ছিল এক অবিশ্বাসের রাত। দীর্ঘ দুশো বছর ধরে রক্ত ঝরানোর পর এসেছে কাঙ্খিত স্বাধীনতা। ভারত অবশ্য ততদিনে দুভাগ হয়ে গেছে, লাখ লাখ মানুষের অসহায়তা দেখেছে। তবুও, এটা স্বাধীনতা…

১৯৪৭-এর পর ১৯৫০। আরও এক মাইলস্টোন। স্বাধীন ভারতে এবার সাধারণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হল। তৈরি হল পৃথিবীর সবথেকে বড়ো এবং সুন্দর সংবিধান। ভারত এবার সব দিক থেকেই এক নতুন স্বপ্নের সওদাগর। এত কিছু তো হল; কিন্তু একটা ব্যাপার আমরা অনেকেই এড়িয়ে যাই। বলা ভালো, অতশত নজরেও আসেনি ইতিহাস পড়তে গিয়ে। কী ব্যাপার? ১৯৪৭-এর ১৫ আগস্ট থেকে ১৯৫০-এর ২৬ জানুয়ারি— এর মধ্যবর্তী সময় ভারতের পরিস্থিতি কী ছিল? কেমন ছিল স্বাধীনতার পরের তিনটি বছর? 

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরেই ব্রিটিশরা বুঝতে পারছিল, তাদের সাধের উপনিবেশগুলো এবার হাতছাড়া হতে চলেছে। আর ভারত তো সেখানে ছিল ‘সোনার ডিম পাড়া রাজহাঁস’! তাকে এত সহজে তো ছাড়া যাবে না। কিন্তু স্বাধীনতা আন্দোলনের ঝাঁজ ক্রমশ বাড়ছিল। শেষ পর্যন্ত স্বাধীনতা প্রদান ছাড়া আর কোনো উপায়ই খুঁজে পেল না ব্রিটিশরা। তখন ভারতের ভাইসরয় লর্ড মাউন্টব্যাটেন। ঠিক করা হল, দেশ স্বাধীন হবে বটে; কিন্তু দুটো ভাগে ভাগ করতে হবে। তৈরি হল ভারত আর পাকিস্তান। র্যা ডক্লিফের ছুরি কয়েক লাখ মানুষকে রাতারাতি ঘরছাড়া করল। 

কিন্তু, স্বাধীনতা এল। তার মানে মাথার ওপর আর ব্রিটিশরা নেই! এখানেই একটু ভুল হল। ওই যে বললাম, ১৯৪৭-১৯৫০’এর মধ্যবর্তী সময়ের কথা। নতুন একটি রাষ্ট্র; তার না আছে আইনকানুন, না আছে সংবিধান। শিল্প-কৃষি-ব্যবসা সবকিছু নিয়েই অনন্ত পরিকল্পনা পড়ে আছে সামনে। হঠাৎ করে কি মাথার ওপর থেকে হাত সরিয়ে নেওয়া যায়? ঠিক হল, যতদিন না সাধারণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা হচ্ছে, ততদিন সিংহাসনে ব্রিটিশরাই থাকবে। ব্রিটিশ রাজশক্তির অধীনে থাকবে ভারত; তবে শুধু এইটুকুই। বাকি ক্ষেত্রে পূর্ণ স্বাধীনতা ভোগ করবে দেশ। তখন বাকিংহাম প্যালেসের মসনদে রয়েছেন সম্রাট ষষ্ঠ জর্জ। তাঁর নামেই শপথ নেবেন ভারতের নেতারা। 

এই পুরো বিষয়টিকে বলা হয় ‘ডোমিনিয়ন পিরিয়ড’। এই সময় ভারতের প্রথম গভর্নর-জেনারেল হলেন বিদায়ী ভাইসরয় লর্ড মাউন্টব্যাটেন। যেহেতু সাধারণ নির্বাচনের কোনো বিষয় ছিল না, তাই সবকিছু সুস্থভাবে টিকিয়ে রাখার জন্যই এমন বন্দোবস্ত। একটা দেশ নতুন করে তৈরি হচ্ছে, তাকে গুছিয়ে নেওয়ার প্রয়োজনীয় সময় তো দিতে হবে। তবে কেবল কেন্দ্রীয় সরকারেই নয়, ভারতীয় সেনাবাহিনীকেও নিয়ন্ত্রণ করতেন ব্রিটিশ ফিল্ড মার্শাল। উচ্চ আদালতে বিচারক নিয়োগও করে দিত ব্রিটিশরা। 

তবে এই তিন বছরে ভারতের ভিত তৈরি করার কাজটি শুরু করে দিয়েছিলেন জওহরলাল নেহরুরা। প্রথমত ও প্রধানত, সংবিধান তৈরির কাজ আরও দ্রুতগতিতে হতে থাকে। দেশের আইনকানুন, শিল্পনীতি, কৃষি-ব্যবস্থা নিয়ে দীর্ঘ আলাপ আলোচনা চলতে থাকে। এবং সেইসঙ্গে দেশীয় রাজ্যগুলোকে ভারতের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করার কাজ চলতে থাকে। সেখানে যেমন ছিল হায়দ্রাবাদের নিজামের রাজ্য, তেমনই ছিল কাশ্মীর। বলা ভালো, এই কয়েক বছর ছিল ভারত রাষ্ট্রের ভিত তৈরি হওয়ার সময়। ব্রিটিশরা কেবল সিংহাসনে বসার দায়িত্বটুকু পালন করেছিল। 

আরও পড়ুন
২৬ জানুয়ারি ভারতের ‘স্বাধীনতা দিবস’, পালিত হয়েছে দীর্ঘ ১৭ বছর!

শেষমেশ এল ১৯৫০ সাল। এল ২৬ জানুয়ারি। এই দিনটি থেকে গোটা দেশে সংবিধান প্রয়োগ করা হল। তৈরি হল নির্বাচনী প্রক্রিয়া। ঠিক এক বছর পরেই যা আয়োজিত হবে দেশ জুড়ে। তৈরি হল শাসন কাঠামো। রাষ্ট্রপতির সিংহাসনে বসলেন ডঃ রাজেন্দ্রপ্রসাদ। সব মিলিয়ে এক নতুন পথ চলা। এবার পুরোপুরি জায়গা ছেড়ে দিল ব্রিটিশরা। ডোমিনিয়ন পিরিয়ড শেষ হয়েছে। এবার ভারতের নতুন করে পথ চলা শুরু। 

Powered by Froala Editor

More From Author See More