মহারাষ্ট্রের গোন্দ উপজাতির (Gond Tribe) অসীম সাহসিকতার কথা তো অনেকেই জানেন। এই কাহিনি ঠিক তেমনই এক সাহসিকতার গল্প। ঘটনাটি ঘটে ১৯২৪ সালের ৯ নভেম্বর। ব্রিটিশ শাসিত ভারতে তখন বনবিভাগের এক কর্মী, এইচ-এস জর্জ ফিরছিলেন বনে টহল দিয়ে। সঙ্গে ছিলেন তাঁর এক নিরাপত্তা রক্ষী, গোন্দ উপজাতির এক সদস্য সামা ভেলাড়ি (Sama Bhelari)। সামার হাতেই ছিল জর্জের বন্দুক। এমন সময়ে হঠাৎ এক নরখাদক বাঘ (Man-eater Tiger) ঝাঁপিয়ে পড়ে জর্জের উপর। সোজা তাঁর টুঁটি চেপে ধরে। কিন্তু সামা বিন্দুমাত্র সময় না নিয়েই সোজা তার বন্দুক তাক করল বাঘের কপালে। বন্দুকের নিশানা তাঁর খুব খারাপ নয়। কিন্তু বন্দুকের সেফটি ক্যাচের ব্যবহার তিনি জানতেন না। তাই শেষ পর্যন্ত ট্রিগার টানতে পারলেন না। কিন্তু তার জন্য ভয় পেয়ে পালিয়ে গেলেন না তিনি। বরং বন্দুক উল্টো করে ধরে বন্দুকের বাঁট দিয়ে একের পর এক সজরে আঘাত করতে থাকলেন বাঘের মাথায়। কিন্তু বাঘও নাছোড়বান্দা। কিছুতেই সাহেবের টুঁটি ছাড়বে না সে। তবে শেষ পর্যন্ত সামার কাছে পরাজয় স্বীকার করতেই হল তাকে।
বাঘ সাহেবের টুঁটি ছাড়ার সঙ্গে সঙ্গেই তাঁকে কাঁধে তুলে দৌড় দিলেন সামা। ক্যাম্পের দূরত্ব খুব বেশি নয়। কিন্তু পিছনে তাড়া করে আসছে বাঘ। অনেক চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে, সঙ্কীর্ণ উপত্যকা পেরিয়ে, নদী পেরিয়ে অবশেষে ক্যাম্পে এসে পৌঁছলেন তিনি। বাঘটি ততক্ষণে অন্য গোন্দদের চিৎকারে এবং ডাকাডাকিতে ভয় পেয়ে পালিয়েছে। চান্দা ক্যাম্পে প্রাথমিক চিকিৎসার পর সাহেবকে নিয়ে যাওয়া হয় নাগপুরের হাসপাতালে। সেখানে ১১ মাস ধরে যমে-মানুষে টানাটানির পর অবশেষে হাসপাতাল থেকে ছাড়া পেলেন সাহেব।
১৯২৫ সালে লন্ডন গেজেট এবং গার্ডিয়ান পত্রিকায় এই খবর প্রকাশিত হয়। আর সেইসঙ্গে জানানো হয় আরও একটি খবর। সামা ভেলাড়িকে অ্যালবার্ট পুরস্কারে পুরস্কৃত করেছে ব্রিটিশ সরকার। এখানে অ্যালবার্ট পুরস্কার সম্বন্ধে কিছু কথা বলা প্রয়োজন। ১৮৬৬ সাল থেকে এই পুরস্কার দিয়ে আসছে ব্রিটিশ সরকার। মহারাণি ভিক্টোরিয়ার স্বামী অ্যালবার্টের নামাঙ্কিত এই পুরস্কার। সাম্রাজ্যের সেরা অসামরিক পুরস্কার হিসাবে বিবেচিত হত পুরস্কার। অসীম সাহসিকতার পরিচয় যাঁরা রাখতেন, তাঁরাই পেতেন এই পুরস্কার।
এর আগে উত্তরপ্রদেশের এক মাঝি অ্যালবার্ট পুরস্কার পেয়েছিলেন। তার বছর দশেকের মধ্যে পেলেন সামা ভেলাড়ি। ভারতে ২০০ বছরের ব্রিটিশ শাসনে এই দুজনই পেয়েছিলেন অ্যালবার্ট পুরস্কার। কিন্তু ইতিহাস তাঁকে মনে রাখেনি। কোথায় সেই সামার পরিবার, কোথায় বা তার মুরওয়াই গ্রাম? কোনোকিছুরই হদিশ রাখেননি কেউ। হয়তো কেউ আর সেই সন্ধান পেতেনও না। কিন্তু এর মধ্যেই ২০১৪ সালে মহারাষ্ট্রের চন্দ্রপুর এলাকায় ইন্স্যুরেন্সের এজেন্ট হিসাবে এলেন অমিত ভগত। কোম্পানির সামান্য একজন এজেন্ট হলেও তাঁর আসল নেশা ছিল ইতিহাসের দিকেই। মহারাষ্ট্রের আনাচে-কানাচে ছড়িয়ে থাকা নানা ইতিহাসের সন্ধান করতে করতেই একদিন তিনি লন্ডন গেজেটের সেই সংখ্যাটা হাতে পেলেন। বুঝলেন, এলাকাটা চন্দ্রপুর অঞ্চলেই। কিন্তু মুরওয়াই গ্রামের সন্ধান তো তিনি জানেন না! আদৌ এমন কোনো গ্রাম আছে নাকি? ম্যাপ খুলেও কোনো হদিশ পেলেন না। এমনকি প্রায় একইরকম উচ্চারণের যত গ্রাম আছে, সেখানেও কোথাও সামা ভেলাড়ির পরিবারের কোনো সন্ধান পাওয়া গেল না।
আরও পড়ুন
বাঘ ভাবতেন নিজেকে, বদলে ফেলেছিলেন চেহারাও!
এমন সময় অমিতের সঙ্গে যোগাযোগ হল একজন প্রাক্তন বনকর্মীর সঙ্গে। তাঁর সঙ্গে কথায় কথায় তিনি জানতে পারলেন, ঝড়পেটা বলে যে গ্রাম সবাই চেনেন, তার আসল নাম নাকি জর্জপেটা। বনদপ্তরের কোনো এক কর্মচারীর নামেই সেই গ্রামের নামকরণ হয়েছিল। কথাটা শোনা মাত্র মাথায় বিদ্যুৎ খেলে যায় অমিতের। তিনি যে কাহিনির পিছনে ছুটেছেন তার কেন্দ্রেও তো আছেন জর্জ নামে বনদপ্তরের একজন কর্মী। অবশেষে সেখানে গিয়ে সন্ধান পাওয়া গেল সামা ভেলাড়ির পরিবারের। সামা অনেকদিন হল মারা গিয়েছেন। সেটাই স্বাভাবিক। কিন্তু সামার ছেলে জগা ভেলাড়ি এখনও বেঁচে আছেন। আর তাঁর কাছেই এখনও আছে সেই বহুমূল্য অ্যালবার্ট পুরস্কারের মেডেল।
আরও পড়ুন
অরণ্য হারিয়ে ঠাঁই শহরে, বৈষম্যে জেরবার ব্রাজিলের প্রাচীন জনগোষ্ঠী
এভাবেই হারিয়ে যেতে যেতেও বেঁচে গেল এক অসামান্য ইতিহাস। কিন্তু দেশের আনাচে-কানাচে এমন কত ইতিহাস লুকিয়ে আছে, তার খবর আর কতজনই বা রাখেন? সব ইতিহাস খুঁজে দেখার জন্য কি অমিত ভগতরা আছেন?
আরও পড়ুন
শিল্পকে হাতিয়ার করেই সভ্যতার সঙ্গে লড়াই ব্রাজিলের বিলুপ্তপ্রায় জনগোষ্ঠীর
Powered by Froala Editor