আর মাত্র ২ দিন বাকি চলতি বছর ফুরোতে। কিন্তু নতুন বছর আসার আগে আরও একবার বিষদাঁত ঝলকে উঠল ২০২০-র। আরও এক নক্ষত্রপতনের সাক্ষী থাকল বাংলা। বছরের শুরুতেই দুই কিংবদন্তি ফুটবলার— পি কে বন্দ্যোপাধ্যায় এবং চুনী গোস্বামীকে হারিয়েছিল বাঙালি। এবার চলে গেলেন ভারতীয় ফুটবলের আরও এক প্রাক্তন তারকা নিখিল নন্দী। বয়স হয়েছিল ৮৯ বছর।
গত সেপ্টেম্বর মাসের শেষের দিকে কোভিড১৯-এ আক্রান্ত হয়েছিলেন প্রবীণ ফুটবলার। তবে করোনাভাইরাসকে হার মানিয়েই বাড়িতে ফিরে এসেছিলেন তিনি। কিন্তু বার্ধক্যের জন্যই ছাপ থেকে যায় সংক্রমণের। ক্রমে বাড়ছিল শারীরিক সমস্যা, দুর্বল হয়ে পড়েছিল শরীর। শেষ অবধি হাসপাতালে ভর্তি করেও লাভ হল না তেমন। চিকিৎসাতে আর সাড়া দিলেন না ভারতের একসময়ের অন্যতম মিডফিল্ডার। মঙ্গলবার সন্ধেতেই থেমে গেল স্পন্দন।
নিখিল নন্দীর জন্ম ১৯৩১ সালের ৩০ নভেম্বর। ছোট থেকেই তাঁর বড় হয়ে ওঠা ফুটবলের আবহে। দুই দাদাকেই খেলতে দেখেছেন ভারতের জাতীয় দলে। পরবর্তীকালে তাঁর ভাই সন্তোষ নন্দীও খেলেছেন ভারতের হয়ে। প্রাথমিকভাবে আঞ্চলিক ক্লাব ফুটবল খেলার পর প্রথম শ্রেণির ফুটবলে তাঁর অভিষেক হয় রেলের হাত ধরেই। তারও পরে ভারতীয় দলের জার্সি গায়ে মাঠে নামেন নিখিল নন্দী। সময়টা ১৯৫৬ সাল। অনেকটা ম্যাজিকের মতোই উত্থান হয়েছিল তাঁর। মেলবোর্ন অলিম্পিকে ভারতীয় দলের মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছিলেন তিনি।
তার ঠিক আগের হেলসিঙ্কি অলিম্পিকেই ১৯৫২ সালে যুগোশ্লোভিয়ার কাছে ১০-১ গোলে পর্যুদস্ত হয়ে বিদায় নিয়েছিল ভারত। ১৯৫৬-তেও ভারতের সামনে কাঁটা হয়ে দাঁড়ায় যুগোশ্লোভিয়া। মাঝমাঠে অসাধারণ ম্যান মার্কিং এবং নিখুঁত ট্যাকেলের জন্য খানিকটা ভরসা করেই তাঁকে মাঠে নামিয়েছিলেন কোচ আব্দুল রহিম। যদিও সেই ম্যাচে যুগোশ্লোভিয়ার কাছে ৪-১ গোলেই হারতে হয়েছিল ভারতকে। কিন্তু অনবদ্য পারফর্মেন্সের জন্য বিপক্ষ দল এবং কোচের থেকেও অভিবাদন আদায় করে নিয়েছিলেন নিখিল নন্দী। মাঝমাঠের দায়িত্ব নিখিল নন্দী সেদিনের সেমিফাইনালে না থাকলে আরও লজ্জার মুখে পড়তে হত ভারতকে।
১৯৫৮ সালের টোকিও এশিয়ান গেমসের সহ-অধিনায়কের দায়িত্বও সামলেছেন নিখিল নন্দী। সেই প্রতিযোগিতায় একটি ম্যাচে ভারতের অধিনায়কও ছিলেন তিনি। বয়সে তিনি খানিকটা বড়ো হলেও অত্যন্ত সখ্য ছিল পি কে বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে। ফুটবলের গেমপ্ল্যান বোঝানো থেকে শুরু করে ভাতৃসুলভ গাইডেন্স সবটাই নিখিল নন্দীর থেকে পেয়েছিলেন পি কে বন্দ্যোপাধ্যায়। ভারতীয় দলের পাশাপাশি একই সঙ্গে দুই তারকাকে এক বছর খেলতে দেখা গিয়েছিল রেলের দলেও। ১৯৫৮ সালে কলকাতার দুই ফুটবল প্রধান মোহনবাগান এবং ইস্টবেঙ্গলকে টপকে লীগ জয় করে ইস্টার্ন রেলের দল। সেখানেও তাঁর ভূমিকা অনস্বীকার্য।
“ফুটবলের কোচিং হোক কিংবা স্ট্র্যাটেজি— নিখিলবাবুর জানার আগ্রহ ছিল অপরিসীম। হাওড়া ইউনিয়ন মাঠে একটা অ্যাকাডেমিতে ফুটবল কোচিং করাতাম আমি। সেখানে টেকনিক্যাল ডিরেক্টর ছিলেন নিখিলবাবু। সপ্তাহে চারদিন সেখানে তাঁর সঙ্গে দেখা হত আমার। অলিম্পিক খেলেছেন কিংবা উনি যে সিনিয়র সেটা কখনোই বুঝতে দিতেন না ব্যবহারে। ভীষণ সাবলীলভাবেই মিলেমিশে কাজ করার পক্ষপাতী ছিলেন। এবং সব থেকে বড় কথা প্রচণ্ড ভদ্র, পরিশীলিত কথা বলতেন উনি। তারপরেও যখনই দেখা হয়েছে রাস্তায়, উনি দাঁড়িয়ে কথা বলেছেন আমার সঙ্গে খেলা, কোচিং সমস্ত ব্যাপারেই”, নিখিল নন্দীর স্মৃতিচারণায় পুরনো দিনের কথা তুলে আনছিলেন প্রাক্তন ফুটবলার প্রশান্ত বন্দ্যোপাধ্যায়।
আরও পড়ুন
নির্বাসন থেকে ফিরেই বিশ্বজয়, প্রয়াত ইতালির কিংবদন্তি ফুটবলার পাওলো রোসি
তবে ভারতীয় ফুটবলে অনস্বীকার্য অবদানের পরেও কি সেইভাবে তাঁকে মনে রাখতে পেরেছে বাঙালি? ফুটবলকে ভালোবেসে চিরকাল রেল ছেড়ে বড়ো দলে খেলেননি বলেই কি? এসব প্রশ্ন উঠে আসতে বাধ্য নিখিল নন্দীর প্রসঙ্গ উঠলেই। অনাড়ম্বর জীবনযাপনের মধ্যে শেষ বয়স অবধি ফুটবলকেই আঁকড়ে ছিলেন তিনি। বছর খানেক আগে পর্যন্তও দমদমে ফুটবল কোচিং চালিয়ে যেতেন আশি-ঊর্ধ্ব ‘তরুণ’ নিখিল নন্দী। স্বপ্ন ছিল বাংলা থেকে তুলে আনা তরুণ প্রতিভাদের। জনা পঞ্চাশেক ছাত্রদের থেকে কখনও সিকি-পয়সাও পারিশ্রমিক নেননি এই কিংবদন্তি।
বড়ো কোনো ক্লাব থেকে কোচিংয়ের জন্য ডাক পাননি সেইভাবে কোনোদিন। তবুও একটা লড়াই চালিয়ে গেছেন একা হাতে। উজাড় করে দিয়েছেন নিজের অভিজ্ঞতাকে। যত ছোটো অ্যাকাডেমিই হোক না কেন, শূন্যস্থান তৈরি হল সেই জায়গাটাতেই। ভারতীয় তথা বাংলার ফুটবল হারাল তার অন্যতম অভিভাবককে। যে ক্ষতি অপূরণীয়...
ঋণ - প্রশান্ত বন্দ্যোপাধ্যায়, অর্পণ গুপ্ত
আরও পড়ুন
পেলের সঙ্গেই পেয়েছেন ফিফার সর্বোচ্চ সম্মান, একমাত্র এশীয় ফুটবলার বাংলার পিকে-ই
Powered by Froala Editor