একদিকে পাহাড়, আর বাকি তিনদিকে বিস্তীর্ণ সমুদ্র। তার মধ্যেই খেলে বেড়াচ্ছে মালভূমি, সমতল ভুপ্রকৃতি; ফুটে উঠছে অরণ্য, শহর, মরুভূমি। এভাবেই প্রতিটা পরতে বৈচিত্র্য নিয়ে জেগে আছে আমাদের দেশ, ভারত। শুধু কি প্রকৃতি? দেশের এক একটা রাজ্যের মানুষের মধ্যেও কত বৈচিত্র্য, কত পার্থক্য? ভাষা, খাবার, সংস্কৃতি, সাহিত্য, উৎসব, ইতিহাস— সব কিছু নিয়েই তৈরি হয়েছে এক মস্ত আয়োজন।
‘বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্য’— এমন মন্ত্রেই বিশ্বাস করে এসেছি আমরা। আমাদের সংবিধানও সেই সনাতন ছবিকেই সম্মান দেয়। তবে এই বৈচিত্র্যের একটু গভীরে গেলে আরও নানা দিক খুলে যায় আমাদের সামনে। ভাষার হাত ধরেই সেই গভীরতার দিকে ঢোকা যাক একটু। এক নয়, ভারতের মানচিত্র জুড়ে খেলা করে নানা ভাষা। একদিকে দেখতে গেলে, এই বিভিন্নতার ছাদই এই দেশকে একটি অন্য রূপ দিয়েছে। উত্তরে গেলে কাশ্মীরি, পাহাড়ি ভাষার সঙ্গে হিন্দি, পাঞ্জাবি; পূর্ব ও উত্তর-পূর্বে বাংলা, ওড়িয়া, ভোজপুরি, অসমিয়া, খাসি-সহ অসংখ্য ভাষার সহাবস্থান। আর দক্ষিণে দেখলে মারাঠা, তামিল, তেলেগু, মালয়ালমের সম্ভার। ভেতরে ভেতরে আরও আরও ভাষার স্রোত বয়ে যাচ্ছে…
ইতিহাসের দিকে তাকালে দেখা যাবে, এই ভাষা নিয়ে নানা সময় নানা আলোচনা উঠে এসেছে। বর্তমানেও ভাষা জাতীয় রাজনীতির একটা অঙ্গ হয়ে দাঁড়িয়েছে। ভাষার ভিত্তিতে তৈরি হয়েছে রাজ্য, জেলা। তবে আরেকটু গভীরে গেলে দেখা যাবে ব্যাকরণগত একটা বৈচিত্র্যও উঠে এসেছে ভারতে। আর তার কেন্দ্রে রয়েছে ভাষার লিঙ্গ। ইংরেজিতে বললে He অথবা She ব্যবহার করলেই লিঙ্গ বোঝানো হয়ে যায়। আর জড়বস্তুর ক্ষেত্রে It-এর ব্যবিহার তো রয়েছেই। এই সূত্র ধরেই ভারতের দিকে যদি তাকানো যায়, তবে ঠিক কী দেখা যাবে?
ভারতের মানচিত্র ও ভাষাগত বিভিন্নতাকে সামনে আনলে এই লিঙ্গ বৈচিত্র্য আরও ভালোভাবে ফুটে উঠবে। একবার ফিরে যাওয়া যাক ছোটবেলায়; যেখানে ম্যাপ পয়েন্টিংয়ের আসর বসত স্কুলে। ভাষাতত্ত্বের গবেষণা দেখাচ্ছে, প্রায় সমগ্র উত্তর ভারত জুড়ে পুং ও স্ত্রী— ভাষার দুটি লিঙ্গই বর্তমান। এমনকি, জড়বস্তুর ক্ষেত্রেও সেই লিঙ্গ চলে আসে। পাঞ্জাবি বা হিন্দির উদাহরণ টানলে আরও সহজে বোঝা যাবে। একদিকে ‘রাম খায়া’, অন্যদিকে ‘নিতু খায়ি’। উত্তর-পূর্ব ও পূর্ব ভারতের দিকে গেলে এই চিত্রটাই বদলে যায়। সেখানে লিঙ্গভিত্তিক ভেদাভেদের কোনো চিহ্ন নেই। আমাদের বাংলা ভাষার দিকে তাকালেই বোঝা যাবে। ‘সে খায়’— এখানে ‘সে’ ছেলে বা মেয়ে যে কেউ হতে পারে। ক্রিয়াপদ ও সর্বনাম কোনো কিছুরই লিঙ্গ নেই। একই জিনিস দেখা যায় ওড়িয়া, অসমিয়া-সহ অন্যান্য ভাষাগুলোর ক্ষেত্রে।
পশ্চিমে গুজরাট এবং দক্ষিণে মহারাষ্ট্র, গোয়া, কর্ণাটকের ক্ষেত্রে তিন ধরণের লিঙ্গের ব্যবহারই আছে— পুং, স্ত্রী এবং জড়। অন্যদিকে প্রতিবেশী ভাষা মালয়ালমে ক্রিয়াপদের ক্ষেত্রে কোনো লিঙ্গভেদ নেই; কিন্তু সর্বনামের ক্ষেত্রে আছে (সেখানে আভান মানে পুং, আভাল মানে স্ত্রী এবং আট মানে জড়)। এই একই জিনিস দেখা যায় খাসি ভাষার ক্ষেত্রেও। তামিলের ক্ষেত্রে এই ব্যাপারটা আরেকটু জটিল। সেখানে ভাষার মূলত দুটি শ্রেণী— ইউয়ারথিনাই এবং আহরিনাই। প্রথমটির ক্ষেত্রে পুং ও স্ত্রী লিঙ্গ বিভাজন আছে, এবং সেই ভাগে মানুষ, দেবতা, শয়তান— এঁরা পড়ছে। আহরিনাইয়ের ভেতর যারা আছে, তাদের ক্ষেত্রে বিভাজনটা হয় জীব ও জড় হিসেবে। তাদের ক্ষেত্রে আলাদা আলাদা শব্দ, আলাদা আলাদা ভাব…
এসব ছাড়াও ভারতের মালভূমি অঞ্চলগুলিতে যেসব আদিবাসী মানুষরা বাস করেন, তাঁদের ভাষার মধ্যে লিঙ্গ ভেদ না থাকলেও, জীব ও জড় প্রভেদ আছে। সব মিলিয়ে ভাষার বিভিন্নতা তো আছেই; তার সঙ্গে অঞ্চল ভেদে বদলে যায় সেই ভাষার ব্যাকরণও। বদল আসে ভাষার লিঙ্গে। আর এসব মিলেই তৈরি হয় এক অদ্ভুত ভারতের চিত্র— যে চিত্রটাই দেখতে চাই আমরা। প্রত্যেকটা ভাষা যেখানে জায়গা পাবে, প্রতিটা মাতৃভাষার হাত ধরে তৈরি হবে এক মিলনক্ষেত্র। কোনো একটি ভাষার রাজত্ব নয়, বরং সব ভাষার সুস্থ সহাবস্থানই এই দেশকে সম্পূর্ণ করে।
Powered by Froala Editor