পলাশীর যুদ্ধের শতবর্ষ পেরিয়ে গেছে তখন। শেষ হয়ে গেছে সিপাহী বিদ্রোহও। স্বাধীনতার আন্দোলনও নিজের গতি পাচ্ছে। এদিকে একজনের ওপর থেকে ব্রিটিশদের রাগ কিছুতেই যাচ্ছে না। তিনি, বাংলার শেষ নবাব সিরাজদ্দৌলা। ইতিহাস যাতে সিরাজকে একজন স্বেচ্ছাচারী, নৃশংস শাসক হিসেবে মনে রাখে, তার জন্য ব্রিটিশরা কম চেষ্টা করেনি। সেই সঙ্গে যুক্ত হল কলকাতার ব্ল্যাক হোল বা অন্ধকূপ হত্যার বিবরণও। সত্যি কি মিথ্যা - জানা যায়নি। কিন্তু ইংরেজরা নিজেদের মতো করে প্রচারে ত্রুটি রাখছিলেন না।
এসব কিছুই নজরে পড়ে একজন বাঙালি আইনজীবীর। ঘটনাচক্রে, ইতিহাসের একজন মনোযোগী গবেষকও তিনি। সত্যিই কি এমনটা ঘটেছিল? এই প্রশ্ন নিয়ে অনুসন্ধানে নামলেন তিনি। তাঁর নিরলস গবেষণা তুলে ধরল একের পর এক সত্য। সিরাজ সম্পর্কে নিজেই লিখলেন একটি বই। সেইসঙ্গে এশিয়াটিক সোসাইটির ভরা সভায় ইংরেজদের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে অন্ধকূপ হত্যাকে মিথ্যে বলে প্রমাণ করেন। সাক্ষ্য হিসেবে রাখেন গবেষণার একের পর এক নথি; সঙ্গে অকাট্য যুক্তি। ইতিহাস নিয়ে মিথ্যে রটনা, গল্পকথা কোনোদিনই যে বরদাস্ত করতে পারেননি অক্ষয়কুমার মৈত্রেয়!
আরও পড়ুন
পুলিশের হাতে গ্রেফতার এড়াতে, পিস্তলের শেষ বুলেট মাথায় গেঁথে নিলেন চন্দ্রশেখর
বাংলার ইতিহাসচর্চায় যে কজন বাঙালির নাম আসবে, তাঁদের মধ্যে অন্যতম হলেন অক্ষয়কুমার। কিন্তু তাঁর নাম যেন খানিক চাপাই পড়ে গেছে। একদিকে যেমন দক্ষ হাতে সামলেছেন ওকালতি, অন্যদিকে নিজের মতো করে চালিয়ে গেছেন পড়াশোনার কাজ। নদীয়ার শিমুলিয়া গ্রামে জন্ম তাঁর। পড়াশোনার শুরুটা হয়েছিল হরিনাথ মজুমদারের হাত ধরে; যাকে বাংলার ইতিহাস চেনে ‘কাঙাল হরিনাথ’ হিসেবে। বাংলার সংস্কৃতির সঙ্গে ইতিহাসের ছোঁয়াটা তাঁর হাত ধরেই অক্ষয়কুমারের মধ্যে এসেছিল। পরে অবশ্য নদীয়া ছেড়ে চলে যান রাজশাহীতে, বাবার কাছে। বাবা ছিলেন সেখানকার উকিল। ইচ্ছা, ছেলেও এই পেশায় আসুক। এসেওছিলেন অক্ষয়কুমার। কিন্তু সেটা পেশার তাগিদে। আসল ভালোলাগার জায়গা তো ছিল অন্য।
ইতিহাস শুধুমাত্র কিছু কল্পকথার ওপর ভিত্তি করে তৈরি হয় না। বরং তাকে জানতে গেলে সত্য, যুক্তি, গভীর অনুসন্ধানের মধ্য দিয়ে যেতে হয়। ঠিক এমনটাই সারাজীবন মনে করে এসেছেন অক্ষয়কুমার মৈত্রেয়। ছোটো থেকেই দুটি বিষয়ে ছিল প্রবল আগ্রহ। ইতিহাস, ও সাহিত্য। টুকটাক লিখতেনও। কলেজে পড়ার সময় হঠাৎই তাঁর হাতে আসে মেকলে’র লেখা ‘ক্লাইভ অ্যান্ড হেস্টিংস’ বইটি। বিচক্ষণ অক্ষয় বুঝতে পারেন, বইতে যা লেখা আছে, তা সত্যি নয়। এরপরই ইতিহাস নিয়ে গবেষণা শুরু করেন তিনি। যা জারি ছিল শেষ দিনটি পর্যন্ত। শুধু ইতিহাস গবেষণাই নয়, রীতিমতো মাঠে নেমে প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন, লোকসাহিত্য, তার ইতিহাস ইত্যাদি নিয়ে অনুসন্ধান করেন। নিজের একাধিক গ্রন্থে ছুঁয়ে গিয়েছেন সেইসব প্রসঙ্গও।
আরও পড়ুন
শুধুই পদার্থবিদ্যা নয়, বাংলার নদী-নালা নিয়েও দীর্ঘ গবেষণা করেছিলেন মেঘনাদ সাহা
সিরাজদ্দৌলা, ফিরিঙ্গি বণিক, রানী ভবানী ইত্যাদি বিভিন্ন ঐতিহাসিক বিষয় নিয়ে তিনি লিখে চলেন একের পর এক লেখা। ইতিহাস নিয়ে একটি পত্রিকাও বের করেন তিনি, নাম ‘ঐতিহাসিক চিত্র’। সেই থেকেই যাত্রা শুরু বাংলার প্রথম ত্রৈমাসিক পত্রিকার। ইতিহাসচর্চা, গবেষণা আর লেখালেখি— সমস্ত কিছু একসঙ্গে চলতে থাকে। ১৯১২ সালে বের করেন তাঁর অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বই ‘গৌড়লেখমালা’। পাল বংশের বিভিন্ন শিলালিপি ও তাম্রলিপির পাঠোদ্ধার করে, তার বাংলা অনুবাদ করে এই বইটি প্রকাশ করেছিলেন তিনি। পরবর্তীকালে গবেষকদের অন্যতম প্রয়োজনীয় বইয়ের তালিকায় এর নাম উঠে আসে।
এ তো গেল ঐতিহাসিক ও সাহিত্যিক অক্ষয়কুমার মৈত্রেয়’র কথা। আরও দুটি বিষয়ে তাঁর অবদানের কথা স্বীকার না করলে বোধহয় অন্যায় হবে। একটা সময় ইংরেজ আমলে সেনাবাহিনীতে কোনো বাঙালিকে নেওয়া হত না। যুক্তি হিসেবে বলা হত, বাঙালিরা নাকি অসামরিক; যুদ্ধ-বিগ্রহ এদের দ্বারা হবে না। এই ব্যাপারে নানা সময় নানা আন্দোলন উঠে আসে। বাঙালি ছেলেরা যাতে যোগ দেয়, তার জন্য ১৯১৬ সালে তৈরি করা হয় ‘বেঙ্গল রেজিমেন্ট কমিটি’। বাঙালি যুবাদের উদ্বুদ্ধ করা, তাদের প্রশিক্ষণ দেওয়াই এদের কাজ। সেই সময় এর সঙ্গে যুক্ত হন অক্ষয়কুমার মৈত্রেয়ও। রাজশাহীতে পল্টন গঠনের জন্য তাঁকে দায়িত্ব দেওয়া হয়। তাঁর দত্তক ছেলেও এই বাহিনীতে যোগ দেন। অবশেষে, তাঁদের সম্মিলিত চেষ্টার ফলেই ব্রিটিশরা ‘বাঙালি পল্টন’ বা ‘ফর্টিনাইন্থ বেঙ্গলি রেজিমেন্ট’ বলে একটি আলাদা বাহিনী গঠন করেন। এছাড়াও, বাংলায় রেশম স্কুল, রেশম চাষ সর্বোপরি রেশম শিল্পের উন্নতিসাধন ও প্রসারেও অবদান রাখেন অক্ষয়বাবু। ১৮৯৮ সালে রাজশাহীতে নিজে একটি রেশম স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন। নিজেও ছিলেন সেখানকার শিক্ষক। তাঁর একান্ত প্রচেষ্টার জন্য পরে রাজশাহী থেকে রেশম ও গুটিপোকার বীজ ছড়িয়ে পড়তে থাকে ভারত ও ভারতের বাইরে।
আরও পড়ুন
১৭০ বছর আগে, পদ্মার নিচ দিয়ে টেলিগ্রাফের তার পেতেছিলেন বাঙালি ইঞ্জিনিয়ার
ওকালতিকে পেশা হিসেবে নিয়েছিলেন। কিন্তু সেই পরিচয়তেই সন্তুষ্ট থাকেননি তিনি। বাংলার আধুনিক ইতিহাসচর্চার অন্যতম প্রবর্তক অক্ষয়কুমার নিজের মতো করে চালিয়ে গেছেন কাজ। স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ তাঁকে ‘আধুনিক বাংলার লেখকদের মধ্যে শীর্ষস্থানীয়’ হিসেবে মনে করতেন। কিন্তু আক্ষেপ, ইতিহাসে লেখা থাকলেও, সমাজ জীবনে তাঁর নাম প্রায় বিস্মৃতই থেকে গেল। তিনি যবে জন্মগ্রহণ করেছিলেন, সেই বছরেই (১৮৬১) জন্মেছিলেন আরও দুই কিংবদন্তি মানুষ; রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং প্রফুল্লচন্দ্র রায়। তিনজনেই তিনটি ক্ষেত্রে অবদান রেখেছিলেন। কিন্তু অক্ষয়কুমার মৈত্রেয় থেকে গেলেন আড়ালের মানুষটি হয়ে।
Powered by Froala Editor