“ভারতের মতো দেশের ভূতাত্ত্বিক ছবিটা অনেক বেশি সমৃদ্ধ। এখানে অনেক প্রাচীন জায়গা আছে, গবেষণার সুযোগ অস্ট্রেলিয়া বা গ্রিনল্যান্ডের থেকে কম নয়। এখানকার গবেষকরাও যথেষ্ট মেধাবী; তাঁরাও যথাসাধ্য চেষ্টা করছেন। কিন্তু তফাৎটা হয়ে যাচ্ছে সাধ আর সাধ্যের মধ্যে। পৃথিবীর যে দেশগুলিতে প্রাচীন শিলা পাওয়া যায় তার মধ্যে ভারত অন্যতম। অথচ সেই বিবর্তনের যে ইতিহাস লুকিয়ে আছে ভারতের ভেতরে, তাকে বাইরে নিয়ে আসার প্রয়াস খুব একটা দেখা যায় না।”
বলছিলেন ডঃ রজত মজুমদার। পেশায় ওমানের জার্মান ইউনিভার্সিটি অফ টেকনোলজির একজন অধ্যাপক। তবে একইসঙ্গে তিনি গবেষক, এবং ভূতাত্ত্বিকও বটে। মাত্র দুবছর আগে তাঁর নাম সমস্ত দৈনিকের পাতায় উঠে এসেছিল। সৌজন্যে, ওড়িশা থেকে পাওয়া পৃথিবীর ‘প্রাচীনতম খনিজ’। প্রায় ৪২৪ কোটি বছরের পুরনো আগ্নেয় শিলা থেকে রজতবাবু এবং তাঁর ছাত্রছাত্রীরা খুঁজে বের করেছেন জারকন। আর তাঁদের সেই প্রচেষ্টাই উঠে এসেছিল সংবাদপত্রের শিরোনামে।
তারপর পেরিয়ে গেছে বছর। ২০২০-তে এসে রজত মজুমদার অধ্যাপনার সূত্রে ওমান নিবাসী। কিন্তু আজও ভেবে চলেছেন ভারতের ভূতাত্ত্বিক ছবিটির কথা। এই পথে আসবেন, সেটা অবশ্য ভাবেননি আগে। দুর্গাপুরে বেড়ে ওঠা রজতবাবুর ছোটবেলা থেকেই প্রত্নতাত্ত্বিক কাজকর্মে উৎসাহ ছিল। “আশেপাশে এরকম বেশ কিছু জায়গা ছিল। ছোটো থেকে ঘুরে ঘুরে সেসব দেখা, খোঁজাই ছিল একরকম নেশা। ভেবেছিলাম কেমিস্ট্রি বা ওই ধরণের বিষয় নিয়ে পরবর্তীতে পড়াশোনা করব। আমার এক শিক্ষক তখন জিওলজি বিষয়টির সঙ্গে আমার পরিচয় করান। তখনই মনে হয়েছিল, আরে! এ তো আমারই বিষয়। ছোটো থেকে তো এসবই করতে ভালোবাসি। তারপর থেকে ভূতত্ত্ব নিয়েই এগিয়েছি।”
আরও পড়ুন
মানব হৃৎপিণ্ডের বিকল্প যন্ত্র তৈরি করে জাতীয় পুরস্কার উত্তরপাড়ার সুমন্তের
তখন রজতবাবু কলেজের ছাত্র। বেশ কয়েকবছর আগে আন্তর্জাতিক জার্নাল ‘সায়েন্স’-এ প্রকাশিত একটি গবেষণার দিকে তাঁর চোখ পড়ে। প্রেসিডেন্সি কলেজের (অধুনা বিশ্ববিদ্যালয়) ভূতত্ত্বের তৎকালীন দুই শিক্ষক আশিসরঞ্জন বসু এবং অসিতকুমার সাহার সেই গবেষণায় উঠে এসেছিল পূর্ব ভারতের একটি বিশেষ আগ্নেয় পাথরের নাম। তার বয়স নাকি প্রায় ৩৮০ কোটি বছর! এদিকে পৃথিবীর জন্মই হয়েছে ৪৬০ কোটি বছর আগে। কাজেই পাথরটিকে বেশ প্রাচীনই বলতে হয়। কিন্তু দুই বাঙালি অধ্যাপকের গবেষণার প্রাপ্ত ফলাফল নিয়ে প্রশ্ন তোলেন বিদেশের কিছু বিজ্ঞানী। তাঁদের মতে, এই গবেষণায় ভুল আছে। পরবর্তীকালে আবারও অসিতবাবু এবং তাঁর সহযোগীরা এই পাথর নিয়ে গবেষণা করেন। কিন্তু আন্তর্জাতিক মানচিত্রে ভারতের এই খবর সেভাবে জায়গা করে উঠতে পারেনি।
আরও পড়ুন
অন্ধকারেও উজ্জ্বল বৃহস্পতির উপগ্রহ, রহস্যভেদ ভারতীয় বিজ্ঞানীর
“এখানেই আমাদের সমস্যা। ভূতাত্ত্বিক দিক দিয়ে ভারত অত্যন্ত সমৃদ্ধ একটি দেশ। বিশেষ করে বাস্তার, উড়িষ্যা, ঝাড়খণ্ড, ছোটনাগপুর অঞ্চল-সহ পূর্ব, দক্ষিণ ও মধ্য ভারতের বেশ কিছু জায়গা নিয়ে ভূতাত্ত্বিকরা অত্যন্ত উৎসাহিত। ঠিকঠাক গবেষণা হলে ভারতের মাটি থেকেই অনেক কিছু উঠে আসতে পারে। তবে বিশ্বের ভূতত্ত্বের গবেষণায় অস্ট্রেলিয়া বা গ্রিনল্যান্ড, কানাডার মতো জায়গা যেরকম অবস্থানে আছে, ভারত সেই জায়গায় নেই। এখানকার খবর খুব বেশি করে ছড়িয়ে পড়ে না। তবে আশার কথা, অবস্থা বদলাচ্ছে। আস্তে আস্তে ভারতের দিকেও ফিরে তাকাতে শুরু করেছেন বাকি গবেষকরা। ২০১৮-তে আমার নিজের গবেষণার জায়গাতেও এটা খেয়াল করেছি”, বলছিলেন ডঃ রজত মজুমদার। বিশ্ববিদ্যালয়ে পরীক্ষা নেওয়ার ফাঁকেই যেন তিনি চলে গেলেন বেশ কিছু বছর আগে।
আরও পড়ুন
ভেজা কাপড় থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন করে জাতীয় পুরস্কার বাঙালি গবেষকের
আশুতোষ কলেজ, ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিস্টিক্যাল ইন্সটিটিউটের মতো জায়গায় অধ্যাপনা করতে করতেই ভারতের এই বিশেষ পাথরটি নিয়ে কাজ করার চেষ্টা শুরু করেন রজতবাবু। সঙ্গী হিসেবে পেয়ে যান তাঁরই কয়েকজন ছাত্রছাত্রী- ত্রিস্রোতা চৌধুরী, শুভব্রত দে, লীনা মল্লিক, প্রিয়াঙ্কা চ্যাটার্জিকে। শুরু হয় অভিযান। এ যেন খড়ের গাদায় সূচ খোঁজা। হাজার হাজার নমুনার মধ্যে কোথায় লুকিয়ে আছে সেই পাথর, সেটা বের করতে গেলে কী পরিমাণ সাধনা ও দক্ষতা দরকার— সেটা জানেন ডঃ মজুমদার এবং তাঁর সঙ্গী গবেষকরা। একসময় ওড়িশার চম্পুয়ার একটি বিশেষ পাথরের দিকে নজর পড়ল তাঁদের। বাকিদের কাছে হয়তো সাধারণ একটি পাথর। কিন্তু ভূতাত্ত্বিকদের অভিজ্ঞ চোখ সেই সাধারণের ভেতরে লুকিয়ে থাকা ‘অসাধারণ’কে খুঁজে নিলেন অচিরেই। যে সে পাথর নয়, এটি আগ্নেয় শিলা গ্রানাইট। তার ভেতর থেকেই পাওয়া গেল জারকন নামক খনিজটি।
“এর পরের ধাপ ছিল পরীক্ষার। কিন্তু যে যন্ত্রে এই পাথর বিশ্লেষণ করে তথ্য বের করা হয়, সেই সেনসিটিভ হাই রেজোলিউশন আয়ন মাইক্রোপ্রোব বা ‘শ্রিম্প’ যন্ত্রটি আমাদের ভারতে নেই। কাজেই গবেষণার কাজ করতে চিনে যেতে হয়েছিল। তারপরই তাজ্জব হয়ে যাই আমরা। বলে রাখা ভালো, জারকন এমন একটি খনিজ যা পৃথিবীর প্রাচীনতম; একইসঙ্গে এর স্থায়িত্ব অনেক বেশি। কাজেই এই খনিজটিকে বিশ্লেষণ করলে সংশ্লিষ্ট পাথরটির সম্পর্কে অনেক কিছুই জানা যায়। সেসব বিশ্লেষণ করেই জানা যায়, ওড়িশার আগ্নেয় শিলাটির বয়স প্রায় ৪২৪ কোটি বছর!” ভালো করে দেখলে, পৃথিবীর জন্মের কাছাকাছি সময় গলিত লাভা জমে এই শিলা তৈরি হয়েছে। আর এবার তৈরির সময় নিয়েও সেরকম প্রতিবাদের কারণ নেই। পরীক্ষা করাই হয়েছে অত্যাধুনিক যন্ত্রের সাহায্যে।
কিন্তু এটাই কি ভারতে করা যেত না? বিভিন্ন সময় এই প্রশ্নটাই তুলেছেন ডঃ রজত মজুমদার। “ভারতের বেশ কিছু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে এই বিশেষ যন্ত্রটি (শ্রিম্প) বসানোর পরিকাঠামো রয়েছে। তারা কথাবার্তাও চালাচ্ছে। হয়তো অদূর ভবিষ্যতে ভারতে বসেও উচ্চমানের ভূতাত্ত্বিক গবেষণা করা যাবে। সেটাই আশা। কিন্তু আসল সমস্যা হল সচেতনতা। ভারতের গবেষণার ক্ষেত্রগুলিকে নিয়ে প্রশাসন আরও বেশি উদ্যোগী, আরও বেশি বিজ্ঞানমনস্ক হলে ভালো হয়। অস্ট্রেলিয়ায় ভূতাত্ত্বিক নমুনা ও জায়গা সংরক্ষণের জন্য আলাদা আইন আছে। সেসব জায়গা থেকে পাথর ভাঙা যায় না; এমনকি গবেষণা করতে হলেও সরকারের অনুমতি দরকার। ভারতে অন্তত সংরক্ষণের কাজটা শুরু হোক। প্রত্নতাত্ত্বিক স্থানগুলির মতো ভূতাত্ত্বিক স্থান ও পাথরগুলোও যাতে নষ্ট না হয়ে যায় সে সম্পর্কে উদ্যোগ নিতে হবে। যাতে বাইরের দেশগুলোও ভারত নিয়ে আরও বেশি করে উৎসাহিত হন।”
বিজ্ঞানমনস্কতার প্রসঙ্গ আলোচনা করতে করতে আরও একটা জিনিস চলে এল মাথায়। জ্যোতিষের অনুষ্ঠানগুলোয় এই জারকন পাথরটির সম্পর্কে অনেক কথা শোনা যায়। অনেকে রত্ন হিসেবে ধারণও করেন। তাহলে কি জারকনের এই ‘ব্যবহারটাই’ সব জায়গায় উঠে আসছে? তার ভূতাত্ত্বিক প্রয়োজনীয়তা, গবেষণার কথা কি মানুষের কাছে পৌঁছচ্ছে না? কথাটা একপ্রকার স্বীকার করে নিয়েও ডঃ মজুমদার বললেন, “একটা কথা আছে, বিশ্বাসে মিলায় বস্তু তর্কে বহুদূর। মানুষ যদি বিশ্বাস করে জারকনের আংটি পরেন, তাহলে পরুক! তবে সবার আগে মানুষকে এইসব গবেষণা সম্পর্কে অবগত করতে হবে। তাদের কাছে যথাসম্ভব সরল ও সহজভাবে পৌঁছতে হবে বিষয়কে। দেশ বিদেশের গবেষণা ও কাজের সঙ্গে পরিচয় করাতে হবে। তাহলেই সবকিছু সম্ভব।”
ওড়িশায় প্রাপ্ত প্রাচীনতম পাথর নিয়ে ত্রিস্রোতা চৌধুরী, রজত মজুমদার ও অন্যান্য সহকর্মীদের গবেষণা আন্তর্জাতিক জার্নাল ‘নেচার’-এর ‘সায়েন্টিফিক রিপোর্ট’-এ প্রকাশিত হবার পরই গবেষকদের টনক নড়ে। তারপর বেশ কিছু দেশ থেকে বিজ্ঞানীরা ভারতে এসে গবেষণা করে গেছেন, নমুনা সংগ্রহ করেছেন। রজতবাবু এটাই চান। আরও বেশি করে যেন এই দেশের ভূতাত্ত্বিক ইতিহাস উঠে আসে পৃথিবীর সামনে। তিনি বিশ্বাস করেন, একদিন না একদিন এই দেশের ভূতত্ত্বের গবেষণা-চিত্রটা আরও মজবুত হবে। সুদূর ওমানে বসেও সেই স্বপ্ন দেখে যাচ্ছেন তিনি। তাঁর ভরসা আছে এখানকার মেধার ওপর। নিজেও থামাননি কাজ। তাঁর ছাত্রছাত্রীরাও আজ গুরুত্বপূর্ণ জায়গায়। সব মিলিয়ে আপাদমস্তক এক বিজ্ঞানমনস্ক ভারতকে তিনি দেখছেন সামনে। আর এই স্বপ্ন সত্যি হবেই!
Powered by Froala Editor