‘বাড়ি তার বাংলা’র হাত ধরে আমার সিনেমার রঙিন জগতে প্রবেশ। সালটা ২০১৩ কি ১৪ হবে, মনে হয় এই সেদিনের কথা। প্রথম ছবি, রিলিজের দিনটা আমার এখনও মনে আছে, আগ্রহ উত্তেজনা সবটাই ছিল তুঙ্গে। তখনও সিনেমার কঠিন লড়াইটা অনুধাবন করিনি। করলাম প্রিমিয়ারের ঠিক সাত দিন পর থেকে। মানুষ পছন্দ করছে, স্ট্যান্ডিং ওবেশন দিচ্ছে, হল হাউজ ফুল, এইসব খবর ঠিক সাতদিন পর থেকে মিলিয়ে যেতে লাগল। ইউনিটে একটা চাপা উত্তেজনা ছড়াচ্ছিল, আর বোধহয় ছবিটা চলবে না। বড়ো-বড়ো হাউজগুলোর ছবি এসে গেছে এবার তোমায় পাততাড়ি গোটাতে হবে। কী করে একটা ৬০/৭০ লাখের ছবি, মাত্র ৭ দিনে তার লক্ষ্যপূরণ করবে সেই সম্পর্কে কেউ কথা বলতে চাইছেন না। রঙ্গনদার (রঙ্গন চক্রবর্তী, পরিচালক) কপালে চিন্তার ভাঁজ। আমার সিনেমা সংক্রান্ত সমস্ত রোম্যান্টিসিজম গুঁড়িয়ে যাচ্ছিল প্রতি মুহূর্তে। প্রথম সিনেমাতেই আমি বাংলার সিনেমা জগতকে নতুন করে আবিষ্কার করে ফেলেছিলাম, তারপর কেটে গিয়েছে ৬/৭ বছর। বারে বারে এই বাস্তবের সামনে দাঁড়িয়েছি, কিন্তু সেই আঘাতটা আজও বেশ দগদগে।
যে ঘটনাটা ছোটো প্রোডিউসার এবং নতুন পরিচালকদের সঙ্গে বারংবারই ঘটে, সেটার ভালো বাংলা হল অবজ্ঞা। বাংলা সিনেমা ইন্ডাস্ট্রি ভীষণভাবে আটকে আছে সেই আশি কিংবা নব্বই এর দশকে। তার বহিরাবরণ বা অন্তর কোনোকিছুর ওপরেই আন্তর্জাতিক অগ্রগতির কোনো প্রভাব পড়েনি। তাই বাংলা সিনেমাও ক্রমশ তার দর্শকের ওপর প্রভাব হারিয়ে কিছু প্রভাবশালীর হস্তগত হয়ে রয়েছে, তারাই এই ধুঁকতে থাকা ইন্ডাস্ট্রির ভাগ্যনিয়ন্তা। এই রোগ যে শুধু সিনেমার, তা বললে ভুল হবে। বাঙালির কৃষ্টি, তার সৃষ্টিশীলতা সর্বক্ষেত্রেই চূড়ান্ত অবক্ষয়ের মুখে। সিনেমা আলাদাই বা হবে কী করে? আমি এরকম প্রচুর ব্যবসায়ীর সঙ্গে কথা বলে দেখেছি, তাঁরা একরকম স্বীকারই করে নেন যে, নতুন কোনো দ্রব্য বিক্রি করার মতো সৃষ্টিশীল চিন্তার অধিকারী তারা নন। দীর্ঘদিন চিন্তাহীন, গতানুগতিক একটা প্রকোষ্ঠে আটকে থাকাই হয়তো এর কারণ। উত্তরণের জন্য যে নিরন্তর প্র্যাকটিসের দরকার সেই সুযোগ তাদের থাকে না। ফলত সিনেমার ব্যবসা ক্রমশ ছোটো হতে হতে কিছু মুষ্টিমেয় মানুষের হাতে এসে পড়েছিল, যাঁরা নিজেদের মতো করে একটা ভঙ্গুর সিস্টেমকে জোড়াতালি দিয়ে চালাচ্ছিলেন, যা ভেঙে পড়তই কোনো-না-কোনো দিন, কারণ ইতিমধ্যে নিউ ওয়েভ বাংলা সিনেমায় জোয়ার আসতে শুরু করেছে। একেকটা ঢেউয়ের ধাক্কায় গোটা সিস্টেমকে আরো বেশি নগ্ন দেখাচ্ছিল, কিন্তু কোনো অবস্থাতেই বড়ো প্রোডিউসার, এক্সহিবিটর, ডিস্ট্রিবিউটর নেক্সাস ভাঙছিল না, আসন্ন নিউ ওয়েভ দেখে তাঁরা একে অপরকে সহায়তা দিচ্ছিলেন এবং এতে সব থেকে বেশি লাভবান হচ্ছিলেন প্রোডিউসাররাই। মুষ্টিমেয় কিছু প্রোডিউসার, যাঁরা এই দুনিয়ার স্বঘোষিত চালক।
এই যে নিউ ওয়েভ বাংলা সিনেমার কথা বলছি, এঁদের ভরসার জায়গা হয়ে উঠল ক্রমশ ওটিটি প্ল্যাটফর্মগুলো। সংখ্যায় কম হলেও বেশ কিছু নিউ ওয়েভ সিনেমা আন্তর্জাতিক শ্রেষ্ঠ ওটিটি প্ল্যাটফর্মগুলিতে বিক্রিবাট্টাও হল, যেখানে আবার তথাকথিত মূল সিনেমাগুলি নিজের জায়গা করতে পারল না। সুতরাং একটা সুস্পষ্ট বিভাজন হল, ওটিটি নিউ ওয়েভ সিনেমার, সিনেমাহল এবং স্যাটেলাইট মূল ধারার সিনেমার।
করোনা ব্রেকআউটের পরে পরিস্থিতি আমূল পাল্টে গেল। সোশ্যাল ডিস্টেন্সিং আইনের কারণে রাজ্যের সব হল বন্ধ, কবে খুলবে তার কোনো নির্দিষ্ট সময় জানা যাচ্ছে না। যেহেতু আমাদের দেশ তথা রাজ্যের প্রশাসক গোষ্ঠীরও উদ্ভাবনী ক্ষমতা নেই, প্রায় সকলেই গতানুগতিক চিন্তার অধিকারী। সেহেতু এইরকম বিপর্যয় মোকাবিলার জন্য কোনো সুস্পষ্ট চিন্তার ইঙ্গিতও নেই। ফলত ধুঁকতে থাকা সিনেমা ইন্ডাস্ট্রি এবার ভেঙে পড়ার মুখে, এই সময়ে দাঁড়িয়ে জাতীয় সিনেমার মানচিত্রে একটা যুগান্তকারী ঘটনা ঘটে গেল। বেশ কিছু প্রোডিউসার তাদের সিনেমা সরাসরি ওটিটি প্ল্যাটফর্মে বিক্রির সিদ্ধান্ত ঘোষণা করলেন। তাতেই নড়েচড়ে বসলেন এক্সহিবিটর ও ডিস্ট্রিবিউটররা। এই নেক্সাস আজকের নয়, যদিও বহুদিন ধরে এরকম আশঙ্কা অনেকেই করছিলেন যে, সিনেমা হল কি আদৌ থাকবে আর? তবুও এটা কেউ মেনেও নিতে পারছিলেন না যে সিনেমা বড়ো পর্দা থেকে এত দ্রুত সরে যাবে। হয়তো একটু তাড়াতাড়িই বলছি, এখনও সময় আসেনি, কিন্তু এটা বাস্তব যে সেই আশঙ্কার মেঘ ছায়া ফেলে দিয়েছে ভারতের সিনেমায়। অদূর ভবিষ্যতে বাংলা সিনেমার প্রোডিউসারদেরকেও এই পদক্ষেপ প্রভাবিত করবে না, সে-কথা জোর দিয়ে বলা যাচ্ছে না। অনেকগুলো দিন অনেকগুলো টাকার ইনভেস্টমেন্ট আটকে, এটাই কি চূড়ান্ত সময় নয় প্রাচীন বিপর্যস্ত প্রাতিষ্ঠানিকতাকে ধাক্কা দেওয়ার? এটাই কি সময় নয় নিউ ওয়েভ সিনেমার পথ ধরার?
কিন্তু তারপর কী হবে? সিনেমা হল এবং তার সংশ্লিষ্ট আপ এবং ডাউন লাইন সেক্টরগুলো থেকে যে প্রভূত পরিমাণ মানুষ কাজ হারাবেন তাদের কী হবে? কী হবে এখনও নির্মীয়মান সিনেমা হলগুলোর? কী হবে সিনেমা নিয়ে সমস্ত রোম্যান্টিসজমের? বড়ো পর্দা, গমগমে শব্দ প্রক্ষেপন আপনাকে যে ২ ঘণ্টার টাইম ট্রাভেল করাত সেসব কিছু কি ইতিহাস হবে? এক্সহিবিটররা কি সবাই ওটিটি প্ল্যাটফর্ম বানিয়ে সেই ব্যবসায় আসবেন? নাকি প্রোডাকশন হাউজগুলো নিজেরাই তাদের নিজস্ব ওটিটি-তে ছবি রিলিজের পথ বেছে নেবে? সেখানে নতুন সিনেমা নির্মাতাদের ভবিষ্যত কী হবে? তারা কি এবার ওটিটিতেও অবজ্ঞার শিকার হবেন? এতগুলো প্রশ্নের উত্তর খুঁজছে একটা গোটা ইন্ডাস্ট্রি এবং তার সঙ্গে জড়িয়ে থাকা কয়েক লক্ষ মানুষ। এই টালমাটাল সময়ের কাছে সব কিছুর উত্তর আছে। এক্সহিবিটররা সময় চাইছেন, প্রোডিউসাররা সময় নষ্ট করতে চাইছেন না। এই চাওয়া ও না-চাওয়ার মাঝে দোদুল্যমান কয়েক লক্ষ পাকস্থলি সেই উত্তরগুলোর অপেক্ষায়।