কলেজস্ট্রিট, যাদবপুর, শ্রীরামপুরের পর ‘ঐতিহ্যবাহী’ কফি হাউজ এবার ডায়মন্ড হারবারেও

কফি হাউস (Indian Coffee House)। কলেজস্ট্রিটের বুকে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকা শতাব্দীপ্রাচীন ভবনটি কলকাতার অন্যতম আইকন। তার সঙ্গে বাংলার শিল্প-সংস্কৃতি-সাহিত্য-গান, এমনকি বিপ্লবেরও নাড়ির যোগ সুপ্রাচীন। তবে শুধু কলেজস্ট্রিটই নয়, ইতিহাস ও ঐতিহ্য জড়িয়ে রয়েছে যাদবপুরের কফি হাউসের সঙ্গেও। তাছাড়া গতবছর শ্রীরামপুরেও নতুন রূপে চালু হয়েছিল কফি হাউসের শাখা। এবার কলকাতার চৌহদ্দির বাইরে আরও একটি কফি হাউস খুলল দক্ষিণে, ডায়মন্ড হারবারে (Diamond Harbor)। 

গতকাল, ৬ জুলাই, আনুষ্ঠানিকভাবে খুলে গেল এই নতুন কফি হাউসের দরজা। ডায়মন্ড হারবার থানার পাশে, জাতীয় সড়কের ওপর অবস্থিত এই নতুন কফি হাউসে সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়েই থাকছে এসি এবং নন-এসি— উভয় ব্যবস্থাই। তার আভ্যন্তরীণ চেহারায় সাবিকিয়ানার ছাপ কম। তবে স্বাদে অবশ্য কোনো আপোষ নেই। ইনফিউশন, কোল্ড কফির পাশাপাশি চিকেন স্যান্ডুইজ, কবিরাজি, চিকেন ওমলেট, ফিস ফ্রাই সবই মিলবে এই নয়া ঠিকানায়। একেবারে কলেজস্ট্রিটের স্বাদেই। জানা গেল, কলেজস্ট্রিটের শেফরাই দ্বায়িত্ব নিচ্ছেন এই নতুন কফি হাউসের। তাছাড়াও ৩৫০০ বর্গফুটের এই কফি হাউস জুড়ে পরিবেশন দেখা যাবে ঐতিহ্যবাহী, সবুজ-সাদা পাগড়ি পরা ওয়েটারদেরও। 

গতকাল কফি হাউসের এই নতুন শাখার আনুষ্ঠানিক উদ্বোধনে হাজির ছিলেন লেখক অমর মিত্র, কবি মৃদুল দাশগুপ্ত, চলচ্চিত্র নির্মাতা সুদেষ্ণা রায়, অধ্যাপিক অনন্যা চক্রবর্তী, বিশিষ্ট লেখক ঝড়েশ্বর চট্টোপাধ্যায়, নাট্যকার দেবপ্রসাদ মন্ডল, কবি ও সমাজকর্মী প্রসূন ভৌমিক প্রমুখ খ্যাতনামা ব্যক্তিত্ব। বিশিষ্ট শিল্পী-সাহিত্যিকদের গল্প-কবিতাপাঠ, বাংলা ব্যান্ডের গানের মাধ্যমেই শুরু হয় এই নতুন কফি হাউসের পথচলা। 

“কলকাতার কফি হাউস আমাদের স্মৃতিতে, আত্মার সঙ্গে জড়িয়ে। আমাদের লিটল ম্যাগাজিন বিজল্পেরও জন্মস্থান কফি হাউস”, বলছিলেন কবি, সমাজকর্মী এবং কফি হাউস সমবায় সমিতির উপদেষ্টা প্রসূন ভৌমিক। শুধু ‘বিজল্প’-ই নয়, যুগের পর যুগ ধরে কলকাতার কফি হাউস আশ্রয় দিয়েছে সংস্কৃতিমনা মানুষদের, হয়ে উঠেছে অজস্র কালজয়ী পত্র-পত্রিকার আঁতুড়ঘর। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, শক্তি চট্টোপাধ্যায়, অ্যালেন্স গিন্সবার্গ, মলয় রায়চৌধুরী, বিনয় মজুমদার, ভাস্কর চক্রবর্তী, শামসের আনোয়ার থেকে শুরু করে হাল আমলের সাহিত্যিক বাংলা সাহিত্য জগতের অনেকেই কম-বেশি পা রেখেছেন কফি হাউসে। আবার স্বাধীনতার আগে কলেজস্ট্রিটের এই কফি হাউস তথা অ্যালবার্ট হল ছিল স্বাধীনতা আন্দোলনের অন্যতম ঠিকানা। 


ব্রিটিশ শাসনকালে অ্যালবার্ট হলের এক তলায় ছিল সে-যুগের ‘ইন্ডিয়ান কফি বোর্ড’। সেখান থেকেই ভারতীয় কফি সরবরাহ করা হত বিলেতে। পরবর্তী এই সংস্থাই হয়ে ওঠে ‘কফি হাউস’-এর অভিভাবক। ১৯৫৭ সালে ১৬ জন কর্মচারীকে ছাঁটাই করে কফি বোর্ড। আর এই ঘটনাই জন্ম দেয় আধুনিক কফি হাউস তথা ‘ইন্ডিয়ান কফি হাউস’-এর। প্রেসিডেন্সি কলেজের অধ্যাপক নির্মলেন্দু গঙ্গোপাধ্যায়ের সহযোগিতা ও অনুপ্রেরণায় তৈরি হয় বিশেষ সমবায় সমিতি বা কো-অপারেটিভ। পরের বছর এই সমবায়কে স্বীকৃতি দেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু এবং তৎকালীন বাংলার মুখ্যমন্ত্রী বিধানচন্দ্র রায়। বর্তমানে কলেজস্ট্রিট এবং যাদবপুর— এই দুটি কফি হাউসই নিয়ন্ত্রিত হয় এই সমবায়ের মাধ্যমেই। তবে শ্রীরামপুর এবং সদ্য-উদ্বো‌ধিত ডায়মন্ড হারবার কফি হাউসটি পরিচালিত হবে এই সমবায় এবং এক বেসরকারি সংস্থার যৌথ উদ্যোগে। 

দক্ষিণ বঙ্গের অন্যতম পর্যটনকেন্দ্র হিসাবে খ্যাতি রয়েছে ডায়মন্ড হারবারের। বাংলার বহু মানুষেরই সপ্তাহান্তের গন্তব্য এই অঞ্চল। ফলে, এই কফি হাউসের সৌজন্যেই নতুন করে ভিড় জমবে পর্যটকদের, বদলাবে অঞ্চলের অর্থনীতি আশাবাদী সকলেই। পাশাপাশি কফি হাউসকে কেন্দ্র করে ডায়মন্ড হারবারেও গড়ে উঠবে সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডল, আলাদা করে তা বলার অপেক্ষা থাকে না। 

ছবি - প্রসূন ভৌমিক

Powered by Froala Editor