তখনও ডিজিটাল মাধ্যমের আমদানি হয়নি। কাকভোর থেকেই সিনেমা দেখার জন্য দীর্ঘ লাইন পড়ত কলকাতার সিনেমা হলগুলি সামনে। তবে সেসব এখন শুধুই স্মৃতি। স্টার থিয়েটার, রংমহল, মিত্রা কিংবা মেট্রো— ধীরে ধীরে কলকাতার বিনোদন থেকে মুছে গেছে সকলের নাম। তবে শুধু কলকাতাই নয়, সারা ভারতের ছবিটাই একই রকম। ক্রমাগত যেন অবলুপ্তির পথেই হাঁটছে সিঙ্গেল স্ক্রিন থিয়েটার। হারিয়ে যাওয়ার আগে এবার তাদের নথিভুক্ত করে রাখার অভিনব উদ্যোগ নিলেন ভারতীয় ফটোগ্রাফার এবং সিনেম্যাটোগ্রাফার হেমন্ত চতুর্বেদী।
বিগত দু’বছর ধরেই তিনি বিভিন্ন মৃতপ্রায় এবং বন্ধ হয়ে যাওয়া ঐতিহ্যবাহী সিনেমা হলের তথ্য সংগ্রহের কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন। প্রস্তুত করছেন ইতিহাসের দলিল। শেষ দু’বছরে সিঙ্গেল স্ক্রিন প্রেক্ষাগৃহগুলির সুলুকসন্ধান করতে মোট ১১টি রাজ্যের পাঁচশোরও বেশি শহরে ঘুরেছেন তিনি। নথিভুক্ত করেছেন ৬৫৫টি সিনেমাহলের বিস্তারিত তথ্য, ইতিহাস এবং সেইসঙ্গে তাদের বর্তমান অবস্থার ছবি। বাদ যায়নি কলকাতাও।
তবে অনেকটা যেন আকস্মিকভাবেই এই উদ্যোগের পথে হাঁটা। বছর দুয়েক আগের কথা। ২০১৯ সালে কুম্ভ মেলায় ছবি তোলার জন্যই হাজির হয়েছিলেন চতুর্বেদী। তবে ভিড় আর মেলার জাঁকজমকে বিরক্ত হয়ে এলাহাবাদের ঐতিহ্যবাহী ভবনগুলি দেখতে বেরিয়ে পড়েন তিনি। ঘুরতে ঘুরতে হাজির হন পরিচিত একটি জায়গায়। লক্ষ্মী টকিজ। সে সিনেমা হলের সামনে গিয়েই অবাক হয়ে যান চতুর্বেদী। বছর কুড়ি আগেও তিনি যেখানে সিনেমা দেখে গেছেন, তার অবস্থা ভগ্নপ্রায়। আসেপাশের দোকানে জিজ্ঞেস করতেই উত্তর মেলে। সেখানে গড়ে উঠবে মাল্টিপ্লেক্স। আর তাই জন্যই গুঁড়িয়ে ফেলা হচ্ছে এলাহাবাদের প্রাচীনএই থিয়েটার। না, কারোর পক্ষেই সম্ভব নয় এভাবে একটা সিনেমা হলের প্রাণ ফিরিয়ে আনা। তবু যদি ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে জানানো যায় অতীতের কথা। সেখান থেকেই শুরু হয়েছিল লড়াই। শহরে শহরে গিয়ে তথ্যসংগ্রহের কর্মসূচি।
অধিকাংশক্ষেত্রেই যে ছবিটি ফুটে ওঠছে তাঁর এই গোটা সমীক্ষায়, তা হল - বর্তমান বাজারের সঙ্গে কোনোভাবেই পাল্লা দিয়ে উঠতে পারছে না সিনেমা হলগুলি। প্রযুক্তি যত উন্নত হচ্ছে, তত যেন সিঙ্গেল স্ক্রিনের সংকট ঘনিয়ে আসছে। চাহিদা বাড়ছে মাল্টিপ্লেক্সের। দ্রুত বদলাতে থাকা সময়ে ঝাঁ চকচকে আবহ নির্মাণ করা সম্ভব হচ্ছে না প্রাচীন হলগুলির পক্ষে।
আরও পড়ুন
সমপ্রেমের সিনেমা, সমকামী অভিনেতাকে নিয়েই ‘বাজিমাত’ হলিউডের
অন্যদিকে আরও একটি বড়ো প্রতিবন্ধকতা ওটিটি প্ল্যাটফর্ম। মোবাইল স্ক্রিনেই বাড়িতে বসে সদ্য প্রকাশিত সিনেমা দেখার সুবিধা যে আরও বাড়িয়ে তুলেছে সংকট। আশি কিংবা নব্বইয়ের দশকে টিভির প্রচলন যেমন এক ধাক্কায় কমিয়ে দিয়েছিল সিনেমা হলের চাহিদা, ওটিটি’র প্রচলন তার থেকেও বড়ো আঘাত হেনেছে সিঙ্গেল স্ক্রিনের ওপরে।
তবে অধিকাংশ সিনেমা হলের কফিনে শেষ পেরেকটি পুঁতে গেছে সাম্প্রতিক মহামারী। দীর্ঘদিন লকডাউনের কারণে হল বন্ধ থাকায় আয় দাঁড়িয়েছে শূন্যে। তাই ক্ষতির ধাক্কা সামলে সিনেমা হলের রক্ষণাবেক্ষণ হোক কিংবা কর্মচারীদের বেতন দেওয়া— সবটাই যেন দায় হয়ে দাঁড়িয়েছে হল-মালিকদের। অনেকেই উপার্জনের জন্য হাঁটছেন বিকল্প পথে। প্রোমোটারদের কাছে বিক্রি হয়ে যাচ্ছে থিয়েটারগুলি।
আরও পড়ুন
সুপারহিট সিনেমার পরেও সুযোগ দেননি ছেলেকে, রাজ কাপুরের সঙ্গে দূরত্ব বাড়ে রাজীবের
চতুর্বেদীর দেওয়া পরিসংখ্যান অনুযায়ী। ২০০৯ সালে ভারতে প্রায় ৯৭০০ সিঙ্গেলস্ক্রিন সিনেমা হলের অস্তিত্ব ছিল। ২০১৯ সালে তা এসে ঠেকে ৬৩০০-তে। বর্তমানে যে সংখ্যাটা আরও দ্রুত হারে কমেছে তাতে সন্দেহ নেই কোনো। তবে শুধু সিনেমার সঙ্গে জড়িত মানুষরাই যে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন এমনটা নয়। ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন সেই থিয়েটারের সঙ্গে পরোক্ষাভাবে জড়িয়ে থাকে ব্যবসায়ী এবং দোকানিরা। উদাহরণ হিসাবে চতুর্বেদী তুলে আনছেন এলফিনস্টোন পিকচার প্যালেসের কথা। হঠাৎ করে নামটা শুনলে থমকে গেলেন নিশ্চয়? মিনার্ভা বা চ্যাপলিন বললে তবে সুবিধা হবে খানিকটা। হ্যাঁ, ১৯০৬ সালে তৈরি কলকাতার এই সিনেমা হলই সারা ভারতের প্রথম সিনেমা হল। দেড় দশক আগে ধূলিসাৎ হয়ে গেছে এই সুপ্রাচীন ঐতিহ্য। বর্তমানে তার জায়গায় তৈরি হচ্ছে সরকারি অফিস। আর হল বন্ধ হয়ে যাওয়ায় ধাক্কা খেয়েছে এলাকার খাবারের দোকানগুলিও। এক সময় উপচে পড়া ভিড় থাকত যেসব দোকানে।
এখনও অস্তিত্বের জন্য সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছে বাকিরা। তবে আর কতদিন চলবে এই অসম লড়াই? মৃত্যুর প্রহর গুনছে কলকাতা-সহ সারা ভারতের ঐতিহ্যবাহী এই সিনেমা হলগুলি। তারপর শুধুমাত্র ইতিহাসের পাতায় নস্টালজিয়া হিসাবেই খুঁজে পাওয়া যাবে তাদের। চতুর্বেদীর উদ্যোগই মনে করিয়ে দেবে হারিয়ে যাওয়া স্বর্ণযুগের গল্প…
আরও পড়ুন
শিশুদের জন্য ছিল শয়নকক্ষের ব্যবস্থাও; উত্তরপাড়ার ‘গৌরী সিনেমা’ ও একটি বাসের গল্প
Powered by Froala Editor