ষাটের দশকের শেষের দিক। বাস্কেটবল ফেডারেশন এবং রেফারিং-এর বিরুদ্ধে গুরুতর অভিযোগ তুলেছিলেন এক তরুণ খেলোয়াড়। জানিয়েছিলেন, বাস্কেটবলের জগতে ভারতের পিছিয়ে থাকার কারণ খোদ ভারতীয় বাস্কেটবল ফেডারেশনের অন্তর্দ্বন্দ্ব। দায়ী ক্ষমতাশালী কর্মকর্তারাও। এই ঘটনার জেরে তিন বছরের জন্য বাস্কেটবল ফেডারেশন নিষিদ্ধ করেছিল তাঁকে। তবে খেলা তাঁকে ছেড়ে গেলেও, খেলাকে ছাড়েননি তিনি। তাঁর লড়াই ভারতকে এনে দিয়েছিল একাধিক আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি।
গুলাম আব্বাস মুনতাসির (Gulam Abbas Moontasir), ভারতীয় বাস্কেটবল (Basketball) জগতে এক কিংবদন্তির নাম। ‘অ্যাংরি ম্যান অফ দ্য সেভেন্টিজ’ নামেই পরিচিত এই খেলোয়াড়ের হাত ধরেই খোলনলচে বদলে গিয়েছিল ভারতীয় বাস্কেটবলের পরিমণ্ডল। বিগত দু’বছর ধরেই একাধিক রোগভোগের পর এবার চিরবিশ্রাম নিলেন অর্জুন পুরস্কারপ্রাপ্ত ভারতের প্রাক্তন বাস্কেটবল অধিনায়ক। বয়স হয়েছিল ৮০ বছর।
১৯৪২ সালে মুম্বাইয়ের নাগপাড়ায় জন্ম গুলামের। ছোটো থেকেই বাস্কেটবল ছিল তাঁর স্বপ্ন, ধ্যান-জ্ঞান। মাত্র ৯ বছর বয়সে নাগপাড়ার স্থানীয় ক্লাবে আনুষ্ঠানিকভাবে বাস্কেটবল খেলা শুরু করেন গুলাম। পরবর্তীতে অ্যান্টিনিও ডিসুজা স্কুল এবং ডিজি রূপায়েল কলেজে পড়ার সময় সেখানকার দলেরও প্রতিনিধিত্ব করেছেন ভারতের প্রাক্তন বাস্কেটবল অধিনায়ক। বোম্বে প্রেসিডেন্সির বি-দলে খেলার সুযোগ জুটে যায় স্কুলে পড়াকালীনই। তখন ১৭ বছর বয়স তাঁর। সকলকে চমকে দিয়েই অঘটন ঘটিয়েছিলেন তিনি। মহারাষ্ট্রের প্রথম শ্রেণির দলকে হারিয়ে ছিনিয়ে এনেছিলেন স্টেট চ্যাম্পিয়নশিপের শিরোপা।
এরপর আর পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। প্রথম রাজ্য স্তর, তারপর জাতীয় দলে সুযোগ। ১৯৬০ সালে মুম্বাইয়ে আয়োজিত একটি ম্যাচে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে প্রথম আন্তর্জাতিক অভিষেক হয় গুলামের। এর চার বছর পর ১৯৬৪ সালে, প্রথমবারের জন্য বিদেশের মাটিতে ভারতের প্রতিনিধিত্ব করেন তিনি। কলম্বোতে আয়োজিত চতুর্দেশীয় প্রতিযোগিতায় রীতিমতো নজর কেড়েছিল তাঁর আক্রমণাত্মক ফুটবল শৈলী।
তবে বিতর্কও কম হয়নি তিনি। দেশের বাস্কেটবল ফেডারেশনের সঙ্গে তাঁর দ্বন্দ্বের কথা তো বলা হয়েছে আগেই। তাছাড়া একাধিকবার খেলা চলাকালীন রেফারির সঙ্গে বাকযুদ্ধে জড়ানোর কারণেও সাময়িকভাবে বরখাস্ত হয়েছেন গুলাম। ঘুরেও দাঁড়িয়েছেন প্রতিবার। বুঝিয়ে দিয়েছেন ভারতীয় দলের মেরুদণ্ড তিনিই।
১৯৬৯ ও ১৯৭৫ সালে আয়োজিত এশিয়ান বাস্কেটবল চ্যাম্পিয়নশিপে ভারতের জাতীয় দলের নেতৃত্ব পান গুলাম। নতুন করে দলগঠন কিংবা স্ট্র্যাটেজি বদলের নেপথ্যেও ছিলেন তিনি। এই পরিবর্তনের ছাপ সুস্পষ্টভাবে প্রতিফলিত হয়েছিল ফলাফলে। ১৯৭৫ সালে প্রথমবারের জন্য এশিয়ান চ্যাম্পিয়নশিপে সেমিফাইনাল খেলে ভারত। তবে ব্যক্তিগত সাফল্য পেলেও, দলগতভাবে চতুর্থ স্থানেই লড়াই শেষ করতে হয়েছিল গুলামকে। তারপর পেরিয়ে গেছে প্রায় ৪৫ বছর। এখনও পর্যন্ত এই প্রতিযোগিতায় দ্বিতীয়বারের জন্য সেমিফাইনালে পৌঁছাতে পারেনি ভারত।
১৯৮৬ সালে, ৪৪ বছর বয়সে আনুষ্ঠানিকভাবে বাস্কেটবল থেকে অবসর নেন কিংবদন্তি খেলোয়াড়। তবে খেলার সঙ্গে যোগাযোগ ছিন্ন হয়নি এতটুকু। নেমেছিলেন প্রশিক্ষকের ভূমিকায়। অনুপ্রেরণা হয়ে উঠেছিলেন হাজার হাজার তরুণ বাস্কেটবল খেলোয়াড়ের। মহামারীর আগে পর্যন্তও তাঁকে নিয়মিত দেখা যেত প্র্যাকটিস কিংবা রাজ্যস্তরের ম্যাচের সাইডলাইনে। বলার অপেক্ষা থাকে না, এমন এক ব্যক্তিত্বের চলে যাওয়া গভীর শূন্যস্থান তৈরি করল ভারতের ক্রীড়াজগতে। যা অপূরণীয়…
Powered by Froala Editor