ওষুধ পরীক্ষার দোহাই দিয়ে প্রাণী-হত্যা, বহুপ্রচলিত রীতিতে ইতি টানতে চলেছে ভারত

যে-কোনো ওষুধকেই বাজারে সহজলভ্য হওয়ার আগে দীর্ঘ পরীক্ষা-নিরীক্ষার মধ্যে দিয়ে যেতে হয়। আর এই দীর্ঘ প্রক্রিয়ার প্রথম স্তরেই থাকে বন্যপ্রাণীরা। প্রথমে ইঁদুর বা গিনিপিগ গোত্রের প্রাণীদের ওপর প্রয়োগ করা হয় সদ্যনির্মিত ওষুধ। তারপর তা ব্যবহার করা হয় কুকুর কিংবা প্রাইমেট গোত্রীয় স্তন্যপায়ী প্রাণীর ওপর। কোনো ওষুধ এই প্রতিটি ধাপ উত্তীর্ণ হলে, তবেই শুরু হয় তার মানব ট্রায়াল। অথচ, জীবনদায়ী ওষুধ (Drugs And Medicines) তৈরির এই মধ্যবর্তী প্রক্রিয়াতেই প্রাণ হারায় হাজার হাজার বন্যপ্রাণী (Wild Animals)। এবার এই ‘বর্বর’ রীতিতে ইতি টানতে চলেছে ভারত সরকার।

‘নিউ ড্রাগস অ্যান্ড ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল রুলস’। সম্প্রতি দীর্ঘ কয়েক দশক ধরে চলে আসা এই নিয়মাবলিতে এবার বেশ কিছু সংশোধন করে স্থায়ী বদল আনল ভারত সরকার। বিশেষ করে নতুন ওষুধ পরীক্ষার ক্ষেত্রে প্রাণীর ব্যবহার প্রতিস্থাপন করাই প্রধান লক্ষ্য এই নয়া সংশোধনীর। প্রশ্ন থেকে যায়, বন্যপ্রাণীর ওপর নতুন ওষুধের প্রাথমিক প্রয়োগ না-হলে, তা কি আদৌ নিরাপদ হবে মানুষের স্বাস্থ্যের জন্য? প্রাণী অধিকার সংরক্ষণ করতে গিয়ে কোথাও মানবকল্যাণের সামনে বাধা হয়ে দাঁড়াবে না তো এই পদক্ষেপ?

ইঁদুর এবং ক্যানাইন— এই উভয় গোত্রের প্রাণীদের সঙ্গেই একাধিক শারীরিক বৈসাদৃশ্য রয়েছে মানুষের। পাশাপাশি বানর বা প্রাইমেট গোত্রের প্রাণীদের থেকেও মানুষের শারীরিক গঠন এবং জৈবিক কার্যকলাপ বেশ জটিল। ফলে, এইসব প্রাণীদের ওপর ওষুধ পরীক্ষা সফল হওয়া মানেই, তা মানবদেহেও সঠিকভাবে কাজ করবে— এমনটা নয় একেবারেই। এহেন উদাহরণ রয়েছে বহু। এ-দেশেই তৈরি বহু ওষুধ অ্যানিম্যাল ট্রায়াল অর্থাৎ প্রাণী দেহে প্রয়োগের পরীক্ষায় সফলভাবে উত্তীর্ণ হলেও, ব্যর্থ হয়েছে মানব ট্রায়ালে। সেই হার প্রায় ৮০ শতাংশেরও বেশি। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই কোনো ইতিবাচক কারণ ছাড়াই বলি হতে হয় অসংখ্য বন্যপ্রাণীকে। সেই কারণেই এই রীতিতে বদল আনতে চলেছে ভারত সরকার। কিন্তু আগামীতে তবে কীভাবে পরীক্ষা করা হবে সদ্যনির্মিত ওষুধ?

এক্ষেত্রে ত্রিমাত্রিক অর্থাৎ থ্রি-ডি অর্গ্যানয়েড, অর্গ্যানস-অন-চিপ এবং অত্যাধুনিক কম্পিউটেশনাল পদ্ধতির ওপরেই নির্ভর করছেন গবেষকরা। বিগত কয়েক দশকে মানবদেহের স্টেম সেল বা স্টেম কোশের ব্যবহারে ত্রি-মাত্রিক সেলুলার কাঠামো তৈরি করতে সক্ষম হয়েছেন গবেষকরা। যা অর্গ্যানয়েড বা ‘মিনি অর্গ্যান’ নামে পরিচিত। থ্রি-ডি প্রিন্টার এবং বায়ো-ইঙ্কের সাহায্যে তৈরি কয়েক মিলিমিটার দৈর্ঘ্য ও প্রস্থের এই অণু-অঙ্গের ওপরেই পরীক্ষা করা হবে নতুন ওষুধ। তা একদিকে যেমন হুবহু মানবদেহে ওষুধের ট্রায়ালের মতোই প্রতিক্রিয়া জানাবে, তেমনই তাতে প্রাণ যাবে না কোনো বন্যপ্রাণীদের। উল্লেখ্য, এই পদ্ধতিতে বিভিন্ন মানব অঙ্গের পরিপূরক কলা কৃত্রিমভাবে তৈরি করা সম্ভব। ফলে, যে-কোনো ধরনের ওষুধের ট্রায়ালের ক্ষেত্রেই ব্যবহার করা যেতে পারে এই পদ্ধতি।

কিন্তু এতদিন কেন ব্যবহার হয়নি এই বিশেষ কৌশল? তার কারণ, এই পদ্ধতি খানিক ব্যয়বহুল। আর সেই কারণেই এই পদ্ধতিকে এতদিন পর্যন্ত দূরে সরিয়ে রেখেছিল ভারতের ফার্মাসিউটিক্যাল সংস্থাগুলি। ২০২১ সালে ইউরোপীয় ইউনিয়ন, ২০২২ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং দক্ষিণ কোরিয়া বদল এনেছিল ওষুধের পরীক্ষার আইনে। প্রাণীর ওপর পরীক্ষা বর্জন করে চালু করা হয়েছিল অর্গ্যানয়েড-ট্রায়াল পদ্ধতি। এমনকি এর আগে হায়দ্রাবাদের এলভি ল্যাবরেটরি-সহ ভারতের একাধিক উন্নত পরীক্ষাগারে চোখ এবং লিভারের ওষুধের ট্রায়াল হয়েছে এই পদ্ধতিতে। ইতিবাচক ফলাফলও দিয়েছে সেই প্রযুক্তি। এবার গণহারে এই প্রযুক্তি ব্যবহারের জন্যই ভারত সরকার বদল আনল কয়েক দশক পুরনো নিয়ামবলীতে। নিশ্চিত করল বন্যপ্রাণী ও মানুষের সংঘাতহীন সহাবস্থানের পথ। যদিও এই নতুন নিয়ম বাস্তবায়িত করতে ও দেশজুড়ে উপযুক্ত পরিকাঠামো গড়ে তুলতে, এখনও দীর্ঘ সময় লাগবে ভারতে।

Powered by Froala Editor