ব্রাজিলকে টপকে সংক্রমণে দ্বিতীয় ভারত; ‘স্বাভাবিকতা’র আড়ালে আরও ভয়ংকর দিন?

বিশ্বের করোনা তালিকায় ভারত উঠে এল দ্বিতীয় স্থানে। টপকে গেল জুন-জুলাইয়ের হটস্পট ব্রাজিলকেও। রবিবার রাতে দেশের মোট সংক্রমণের সংখ্যা গিয়ে দাঁড়াল ৪১ লক্ষ ৯৭ হাজার। যেখানে ব্রাজিলের সংক্রমণ ৪১ লক্ষ ২৩ হাজার। এরই মধ্যে দৈনিক সংক্রমণের ক্ষেত্রে ভারত তৈরি করেছে বিশ্বরেকর্ডও। শনিবার আক্রান্ত হয়েছেন ৯০ হাজারের বেশি মানুষ। রবিবার এই সংখ্যা খানিকটা হলেও কমল। আক্রান্তের সংখ্যা দাঁড়াল ৮৬ হাজার ৭২৪ জন।

দেশের মধ্যে সংক্রমণের শীর্ষে এখনও অবধি রয়েছে মহারাষ্ট্র। তামিলনাড়ুকে পেরিয়ে দ্বিতীয় স্থানে উঠে এসেছে অন্ধ্রপ্রদেশে। গত ৪-৫ দিন সংক্রমণ ৩ হাজারের কম থাকলেও রবিবার রাজ্যে আক্রান্ত হলেন ৩০৮৭ জন। ফলে রাজ্যের আক্রান্তের সংখ্যা দাঁড়াল ১ লক্ষ ৮০ হাজার। নিম্নমুখী গ্রাফের হঠাৎ এই চরিত্রবদল উদ্বেগ তৈরি করছে বাংলায়। তবে বাংলায় বর্তমানে দৈনিক আক্রান্তের থেকে দৈনিক সুস্থতার সংখ্যা খানিকটা হলেও বেশি। ২৪ ঘণ্টায় হয়েছে ৪৬ হাজার করোনা পরীক্ষা। যা একদিকে থেকে স্বস্তি দিচ্ছে প্রশাসনকে। তবে আসাম, বিহার, উত্তরপ্রদেশ, উড়িষ্যা, হরিয়ানা, তেলেঙ্গান, ছত্তিশগড়, কর্ণাটকের মতো রাজ্যগুলির অবস্থার গুরুতর অবনতি চিন্তা বাড়াচ্ছে স্বাস্থ্যদপ্তরের।

গত দু’দিন ধরেই পৃথিবীর প্রায় এক তৃতীয়াংশ সংক্রমণের কেন্দ্রস্থল হয়ে উঠেছে ভারত। রবিবারেও অব্যহত থাকল সেই ট্রেন্ড। একদিনে ৯৭৭ জন মারা যাওয়ায় মৃত্যুর সংখ্যা গিয়ে দাঁড়াল ৭১ হাজার ৬৫৬। সুস্থ হয়েছেন সাড়ে ৩২ লক্ষ মানুষ। 

প্রশ্ন উঠছে, কবে আয়ত্তে আসবে এই সংক্রমণ? এটাই কি সংক্রমণের চূড়ান্ত শিখর? গত কয়েকদিনের পরিসংখ্যান দেখলে বোঝা যায়, দৈনিক আক্রান্ত এবং দৈনিক সুস্থতার মধ্যে রয়েছে অন্তত ২০ হাজারের স্পষ্ট ব্যবধান। অর্থাৎ প্রতিদিন বেড়ে চলেছে সক্রিয় আক্রান্তের সংখ্যা।  দু’মাস আগেও দেশে দৈনিক সংক্রমণের সংখ্যা দিনে যদি গতদিনের থেকে ৫০০-ও কম হত, তা ইতিবাচক দিক হিসাবেই বিবেচ্য ছিল। বোঝা যেত লকডাউনের প্রভাব আদৌ কতোটা পড়ছে। কিন্তু এখন একদিনে দৈনিক সংক্রমণ হাজার পাঁচেক কমলেও তা ভরসার ইঙ্গিত দিচ্ছে না আর। কারণ পরের দিনই রেকর্ড ব্রেক করে ১০ হাজার সংক্রমণ বাড়ার আশঙ্কা থেকেই যাচ্ছে। 

তবে এই পরিস্থিতির মধ্যেও প্রায় সবকিছুতেই ছাড়পত্র দিয়ে দিয়েছে সরকার। লকডাউনের সিদ্ধান্তও এখন আর নেই রাজ্য সরকারগুলির হাতে। সেক্ষেত্রেও কেন্দ্রের ওপরেই তাদের নির্ভর করতে হবে। ২০ সেপ্টেম্বর থেকে বিবাহে ১০০ জন আমন্ত্রিত হতে পারবে। সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক, ধর্মীয় অনুষ্ঠানও অনুষ্ঠিত হতে পারবে বিনা বাধায়। হবে রাজনৈতিক সভাও। ৩০ সেপ্টেম্বর অবধি বন্ধ থাকবে স্কুলগুলি। তারপর ৫০ শতাংশ শিক্ষকদের নিয়ে চলবে সেগুলিও। ছাত্রছাত্রী ও অবিভাবকদের অনুমতি নিয়ে নবম থেকে দ্বাদশ শ্রেণীর শিক্ষার্থীদের জন্য বিদ্যালয় খুলে দেওয়ার পরিকল্পনাও রয়েছে সরকারের। গণ পরিবহনেও ছাড়। চালু হচ্ছে মেট্রো। লোকাল ট্রেন চালানোর পরিকল্পনাও বাস্তবায়িত হবে খুব শীঘ্রই।

৯০ হাজার সংক্রমণের দিনেও সরকারের এই খোলামেলা সিদ্ধান্তের সহজ কারণ হল অর্থনৈতিক মন্দা ঠেকানো। নিষেধ তুলে স্বাভাবিক জনজীবন ফিরিয়ে না আনলে আরও বড় ধাক্কা খাবে দেশ আর্থিকভাবে। অথচ এই মুহূর্তে সরকারের একটা বড় আয়ের অংশ চলে যাচ্ছে দেশের করোনা পরিস্থিতির মোকাবিলায় তা দেখাই হচ্ছে না। 

আরও পড়ুন
দেশের সব হাইকোর্টেই রায়দান কমেছে ৫০ শতাংশ, সৌজন্যে করোনা

২০১৯ সালে প্রকাশিত ‘গুড ইকোনমিএক্স ফর হার্ড টাইমস’ বইতে নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায় একটা সাধারণ উদাহরণ দিয়েছিলেন। ম্যালেরিয়া বা ডেঙ্গু জাতীয় মশা-বাহিত রোগে প্রতিবছর আক্রান্ত হন বহু মানুষ। তবে যদি আগে থেকেই তাঁরা মশারির ব্যবহার করেন, তবে কমে আসে এই আক্রান্ত হওয়ার প্রবণতা। স্বাস্থ্য এবং চিকিৎসার ক্ষেত্রেও খরচ তাতে কমে। আর বৃহত্তর অর্থে তা দেশের সার্বিক আয়েই সংযুক্ত হয়।

এই দৃষ্টিভঙ্গি থেকে অনেকটা সরে এসেই লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে ভারত। কিংবা বলা ভালো লড়াই না করেই হাত গুটিয়ে নিয়েছে পরিস্থিতির সামনে। স্বাস্থ্য ব্যবস্থার পরিকাঠামো মজবুত হলে, সংক্রমণ দ্রুত আয়ত্তে আনতে পারলেই অনেকটাই কমে যেত অর্থব্যয়। তাতে এককালীন বড় অর্থিক ধাক্কা বইতে হত হয়তো, কিন্তু সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে আসার পরে তা বাড়িয়ে দিত কাজের মানও। ফলে তা প্রতিফলিত হত দেশের সার্বিক উৎপাদনেও।

আর্থিক অনটনের সামাল দিতে প্রশাসন এই সিদ্ধান্তের জন্য বারবার ঢাল হয়ে দাঁড় করাচ্ছে মৃত্যুর হারকে। বলা হচ্ছে দেশের মৃত্যু হার পৃথিবীর অন্যান্য দেশের তুলনায় অনেকটাই কম। কিন্তু যদি সংখ্যার নিরিখে দেখা যায় তবে ৭৬ হাজার সংখ্যাটা কি সত্যিই নগণ্য? লকডাউন শুরুর দিকে যেখানে ৫-১০টা মৃত্যুর ক্ষেত্রেও তৎপরতা দেখানো হচ্ছিল, সেটা আজ দৈনিক মৃত্যু হাজারের কাছাকাছি হওয়ার পরেও বেমালুম হাওয়া।

আরও পড়ুন
এক বছরে আত্মঘাতী ৪২ হাজার কৃষক ও মজুর, করোনা-পূর্ব পরিসংখ্যানেও স্বস্তি কই!

সংক্রমন নিয়ন্ত্রণে সরকারের এই হালকা মেজাজ প্রতিফলিত হচ্ছে মানুষের মধ্যেও। অধিকাংশ মানুষই মাস্ক পরে বাড়ির বাইরে বেরচ্ছেন না। বেরলেও তা ঝুলে থাকছে কানে, গলায়। আর হবে নাই বা কেন? সমস্ত বাধা-নিষেধ শিথিল করে দেওয়ার মধ্যে যেন এই বার্তাই পৌঁছে যাচ্ছে, নিরাপদ হয়ে গেছি আমরা। চিন্তার কিছুই নেই।

যেখানে নিউজিল্যান্ডে সংক্রমণ শূন্য হয়ে যাওয়ার মাস তিনেক পরে প্রথম মৃত্যুর জন্য পিছিয়ে যাচ্ছে নির্বাচন, আমাদের দেশে রাজনৈতিক স্বার্থই সেখানে প্রধান নির্ণায়ক হয়ে দাঁড়িয়েছে। দিব্যি চলছে মাস্ক ও গ্লাভসের ব্যবহার করেই সংক্রমণের মধ্যে ভোট করার পরিকল্পনা। ভাবা হচ্ছে না সাধারণ মানুষের সকলের কাছে আদৌ কি থাকবে গ্লাভস কেনার আর্থিক সক্ষমতা। আদালতের বিচার পদ্ধতি, অধিকাংশ সরকারি কাজকর্ম অনলাইনেই সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। কিন্তু দেশের পড়ুয়াদের এই অবস্থাতেও পাঠানো হচ্ছে পরীক্ষাকেন্দ্রে। এটা কি দ্বিচারিতাকেই চিহ্নিত করে না? 

ভারত সরকার একদিকে যেমন নির্বাক হয়েই দেখছে এই দৃশ্য। তেমনই সংবাদমাধ্যমগুলির কাছেও এই পরিস্থিতি অনেকটাই গা-সওয়া হয়ে গেছে। ট্রেন্ড তাই করোনা থেকে সরে এসেছে রিয়া চক্রবর্তী আর আইপিএলে। দশ লক্ষের এক একটা হার্ডল পার হলেই সাময়িকভাবে ডঙ্কা বাজছে। তারপর আবার সব চুপচাপ। এভাবেই কি পেরিয়ে যাব আমাদের এই কঠিন সময়? এভাবেই কি ‘ভারত আবার জগতসভায় শ্রেষ্ঠ আসন লবে’?

আরও পড়ুন
মৃত্যুমিছিলে তৃতীয়, সংক্রমণের নিরিখে প্রথম : করোনার নয়া এপিসেন্টারে ‘স্বাগতম’

Powered by Froala Editor

More From Author See More

Latest News See More