ভারতের বুকে পিরামিড, ইউনেস্কোর স্বীকৃতির দৌড়ে অসমের ‘মৈদাম’

পিরামিড বললেই চোখের সামনে ভেসে ওঠে মিশর, সুদান কিংবা চিলির ছবি। কিন্তু যদি বলা হয় ভারতের বুকেও রয়েছে পিরামিডের (Pyramid) নিদর্শন। এবং, তার সঙ্গেও ঘনিষ্ঠভাবে জড়িয়ে রয়েছে মিশরীয়দের সমাধিস্থ করার সংস্কৃতি? 

খানিকটা অবাক হবেন বৈকি। তবে প্রতিবেশী রাজ্য অসমে (Assam) গেলেই দেখা মিলবে এমন আশ্চর্য নিদর্শনের। অসমের চড়াইদেও জেলা। একসময় এই অঞ্চলই ছিল প্রাচীন অহম রাজবংশের অন্যতম কেন্দ্র, এমনকি রাজধানীও। আর সেখানে গেলেই দেখা মিলবে আশ্চর্য সব ‘ভারতীয় পিরামিড’-এর। স্থানীয় ভাষায় যা পরিচিত ‘মৈদাম’ নামে। 

হ্যাঁ, আমাদের বহুপরিচিত মিশরের পিরামিডের সঙ্গে এই পিরামিডের বেশ কিছু আকৃতিগত পার্থক্য রয়েছে বটে। তবে অসমের এই পিরামিডগুলিও আদতে সমাধিক্ষেত্র। সেখানে শায়িত রয়েছে প্রাচীন অহম রাজবংশের সম্রাট, সম্রাজ্ঞীদের নিথর দেহ। 

চতুষ্কোণ নয়, বরং অষ্টভূজাকৃতি আকারের ভূমির ওপরেই তৈরি হত এই ধরনের পিরামিড। চারদিক থেকে তাকে ঘিরে রাখত ইটের নিচু পাঁচিল। সেই পাঁচিলের মধ্যেই থাকত ‘পাতাল’-এ প্রবেশের পথ, নিচে নামার সিঁড়ি। মিশরের পিরামিডের মতোই, অসমের মৈদামের পেটের ভেতর তৈরি করা হত পৃথক পৃথক কক্ষ। কোথাও শায়িত রাখা হয় সম্রাটদের। আবার কোথাও রেখে আসা হত তাঁর ব্যবহৃত আসবাব, অলঙ্কার, দৈনন্দিনের ব্যবহৃত সামগ্রী। অহমিয়াদেরও বিশ্বাস ছিল, মৃত্যুর পর রয়েছে এক অন্য জীবন। আর সেই কারণেই ব্যক্তির মৃতদেহের সঙ্গে সমাধিস্থ করা হত তাঁর ব্যবহারিক সামগ্রীকে। তবে মিশরের পিরামিডের সঙ্গে মৈদামের মূল পার্থক্য হল তার বাইরের দেওয়াল। পিরামিডের ক্ষেত্রে যেমন মূল স্থাপত্যটি সম্পূর্ণভাবে নির্মিত হত পাথর দিয়ে। এক্ষেত্রে, সমগ্র কক্ষ এবং স্থাপত্যটিকে মাটির ঢিবিতে ঢেকে দেওয়া হত। তার ওপর লাগানো হত ঘাসের চারা। আর মাটির তৈরি এই পিরামিডের মাথায় জেগে থাকত ছোট্ট একটি মন্দির। যা পরিচিত চাও চালি নামে। 

আনুমানিক ত্রয়োদশ থেকে ঊনবিংশ শতকের শুরুর দিক পর্যন্ত অসমে বজায় ছিল এইধরনের মৈদাম তৈরির রীতি। পরবর্তীতে অহমিয়ারা হিন্দু ধর্ম গ্রহণ করে মৃতদেহ সমাধিস্থ করার এই প্রথা বিলুপ্ত হয়। ইতিহাসের সাক্ষ্য হয়ে থেকে যায় মৈদাম। 

তবে বলার অপেক্ষা থাকে না, সেই ইতিহাস সংরক্ষণের চেষ্টা হয় দীর্ঘদিন। বরং, মুঘল এবং পরবর্তীতে ইংরেজ শাসনকালে আগ্রাসন চলেছে অসমের এই প্রাচীন প্রত্নক্ষেত্রগুলিতে। মৈদামের অভ্যন্তরীণ কক্ষগুলি থেকে লুঠ হয়েছে বহুমূল্য রত্নসামগ্রী, সোনা-দানা। এমনকি দেশ স্বাধীনের পরও দীর্ঘদিন সামগ্রিক ভারতের কাছে অজানাই থেকে গেছে ইতিহাসের এই আশ্চর্য বর্ণময় অধ্যায়টি। 

সাম্প্রতিক সময়ে, বিশেষত একুশ শতকের শুরু থেকে মৈদাম নিয়ে জনসচেতনতা তৈরির জন্য বিশেষ উদ্যোগ নেয় অসম প্রশাসন। চালু হয় সংরক্ষণ প্রকল্পও। এখনও পর্যন্ত সবমিলিয়ে ৩০০টির বেশি মৈদামের হদিশ পেয়েছেন প্রত্নতাত্ত্বিকরা। যার মধ্যে ৯০টিকে সংরক্ষিত করা হয়েছে। আর্কিওলজিক্যাল সার্ভের তালিকাতেও জায়গা পেয়েছে তারা। বাকিগুলির সংরক্ষণ প্রক্রিয়া চলছে এখনও। মজার বিষয় হল, এখনও পর্যন্ত অধিকাংশক্ষেত্রেই অজানা মৈদামগুলির মধ্যে সমাধিস্থ থাকা সম্রাট বা সম্রাজ্ঞীর পরিচয়। 

২০১৪ সালের কথা। ইউনেস্কোর হেরিটেজ সাইটের তালিকায় মৈদামকে জায়গা দেওয়ার জন্য লড়াই শুরু করেছিলেন অসমের প্রত্নতাত্ত্বিকরা। ২০১৯ সালে তাঁদের এই উদ্যোগের পাশে দাঁড়ায় খোদ অসম সরকারও। ২৫ কোটি টাকার বিনিময়ে আন্তর্জাতিক পেশাদার গবেষণা সংস্থাকে দায়িত্ব দেওয়া হয়, বিজ্ঞানসম্মত ও ঐতিহাসিক নথি নির্মাণের। চলতি বছরে ভারতের ৫২টি অঞ্চল মনোনয়ন পেয়েছে ইউনেস্কোর হেরিটেজ সাইটের। আর সেই তালিকায় অন্যতম মৈদাম-এর জন্য বিখ্যাত অসমের চড়াইদেও অঞ্চল। নেপথ্যে, গবেষকদের তৈরি ঐতিহাসিক ও প্রমাণ্য নথি। ‘ভারতীয় পিরামিড’ ইউনেস্কোর হেরিটেজের চূড়ান্ত স্বীকৃতি পাবে কিনা, তা তো সময়ই বলবে। তবে এই মনোনয়নে ইতিহাসের এই অজানা অধ্যায় পৌঁছে গেল ভারতের বিভিন্ন প্রান্তের মানুষের কাছে, তাতে সন্দেহ নেই কোনো…

Powered by Froala Editor