গত বছর অক্টোবর মাস থেকেই ধীরে ধীরে নিম্নমুখী ছিল ভারতের করোনার গ্রাফ। আর সেই ঘটনাকে কেন্দ্র করে চূড়ান্ত আত্মবিশ্বাস জেগে ওঠে সরকারের। তবে করোনাভাইরাসের দ্বিতীয় তরঙ্গ যে অচিরেই আছড়ে পড়তে চলেছে ভারতীয় ভূখণ্ডে, সে ব্যাপারে সতর্ক করেছিলেন বৈজ্ঞানিক উপদেষ্টামণ্ডলীর পাঁচ গবেষক। গত নভেম্বর তো বটেই, চলতি বছরের মার্চ মাসেও করোনাভাইরাসের অতি-সংক্রামক স্ট্রেনের ক্ষমতার ব্যাপারে সরকারকে অবগত করেছিলেন তাঁরা। সম্প্রতি প্রকাশ্যে এল এমনই চাঞ্চল্যকর তথ্য।
গত বছরই করোনা প্রতিরোধে তৈরি করা হয়েছিল ‘আইএনএসএসিওজি’ উপদেষ্টা ফোরাম। ভারতের খ্যাতনামা গবেষক ও ভাইরোলজিস্টদের নিয়ে তৈরি এই ফোরাম গত নভেম্বরেই কেন্দ্রকে সাবধান করেছিল জন-সচেতনতা নিয়ে। প্রশ্ন তুলেছিল দূরত্ববিধিতে সরকারের গা-ছাড়া ভাব এবং স্বাস্থ্যমন্ত্রকের ভূমিকা নিয়েও। তবে এসবে কর্ণপাত করেনি সরকার। বরং কর্মকর্তাদের দৃঢ় বিশ্বাস ছিল কেবলমাত্র ভ্যাকসিনেশনের মাধ্যমেই সমাধান মিলবে মহামারীর। একদিকে যখন ব্রিটেন দ্বিতীয় তরঙ্গের ধাক্কায় নাজেহাল, তখন এদেশের প্রশাসন নিশ্চিত ছিলেন যে সাধারণ মানুষের মধ্যে তৈরি হয়েছে ‘হার্ড-ইমিউনিটি’। অতএব ভারত সম্পূর্ণ বিপদমুক্ত দ্বিতীয় তরঙ্গ থেকে। সম্প্রতি, নাম প্রকাশ না করেই রয়টার্স পত্রিকায় এমনই বিস্ফোরক তথ্য সামনে এনেছেন উপদেষ্টা ফোরামের পাঁচ গবেষক।
গত ফেব্রুয়ারি মাসে ভারতে প্রথম পাওয়া যায় করোনাভাইরাসের ‘বি.১.৬১৭’ স্ট্রেনটি। তার কয়েকদিনের মধ্যেই ক্ষমতাসীন মন্ত্রীদের সতর্ক করেছিলেন গবেষকরা। জানানো হয়েছিল সাধারণ ভাইরাল স্ট্রেনের থেকে এই স্ট্রেনটি আরও বেশি সংক্রামক। পাশাপাশি, শরীরের সাধারণ প্রতিরোধ ক্ষমতাকেও অনায়াসেই ভেদ করে যাওয়ার ক্ষমতা রয়েছে এই স্ট্রেনের। গবেষকদের সন্দেহ ছিল, ভারতীয় পরিবেশে নতুন করে অভিযোজনের পথ বেছে নিতে পারে করোনাভাইরাস। হয়ও তেমনটাই। কিছুদিন পরেই পাওয়া যায় ‘বি.১.৬১৮’ বেঙ্গল স্ট্রেন।
কিন্তু এতকিছুর পরেও দূরত্ব বিধি কিংবা অন্যান্য বিধিনিষেধে সেভাবে নজর দেয়নি প্রশাসন। বরং, প্রাধান্য পেয়েছে ধর্মীয় উৎসব এবং রাজনৈতিক সমাবেশ। সেই জনস্রোতে মানা হয়নি ন্যূনতম স্বাস্থ্যবিধি। যা আরও ভয়াবহ করে তোলে মহামারীর পরিস্থিতিকে।
আরও পড়ুন
করোনার দ্বিতীয় তরঙ্গে বিপর্যস্ত নেপাল, আত্মসমর্পণ সরকারের
অন্যদিকে গত ফেব্রুয়ারির শেষ থেকেই যখন একটু একটু করে মাথা চাড়া দিচ্ছিল সংক্রমণ, তখনও পর্যন্ত স্বাস্থ্য সংকটের কথা বিন্দুমাত্র চিন্তা করেনি ভারত সরকার। এড়িয়ে যাওয়া হয়েছিল চিকিৎসা পরিকাঠামো জোরালো করার প্রস্তাবও। দৈনিক সংক্রমণে চার লক্ষের সীমানা ছাড়িয়ে যাওয়া তারই ফলাফল।
আরও পড়ুন
রেমডিসিভির মানেই করোনা-জয় নয়, জানাচ্ছেন চিকিৎসকরা
এখানেই শেষ নয়। বিশ্বের দ্বিতীয় জনবহুল দেশ হওয়ায় পরিস্থিতি হতে চলেছে ভয়াবহ, এমনটাই জানাচ্ছেন বিশেষজ্ঞরা। চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীদের আক্রান্ত হওয়ার ফলে আগামীতে আরও কঠিন হতে চলেছে এই লড়াই। পরিকাঠামোর অভাব তো রয়েইছে, সেইসঙ্গে চিন্তা বাড়াচ্ছে ভ্যাকসিনেশনের ধীর গতি। এই মুহূর্তে যে রাষ্ট্রীয় স্তরে কোনো লকডাউন হবে না, সে কথাও ঘোষণা করেছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। সব মিলিয়ে যেন অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠেছে মহামারী। তবে ফেব্রুয়ারি থেকেই যদি আংশিক লকডাউন কিংবা সাপ্তাহিক লকডাউনের পথ বেছে নেওয়া হত জাতীয় স্তরে, তাহলে হয়তো দেখতে হতো না আজকের এই বিপর্যয়।
আরও পড়ুন
করোনার একাধিক স্ট্রেন সক্রিয় ভারতে, হার মানছে অ্যান্টিবডিও
গত বছরের শেষে আইসিএমআরের সেরো সমীক্ষা জানিয়েছিল, ভারতে প্রতি পাঁচ জনের মধ্যে একজন আক্রান্ত হয়েছেন অথবা সংস্পর্শে এসেছেন ভাইরাসের। ধারণা করা হচ্ছে, দ্বিতীয় তরঙ্গে আক্রান্ত হতে চলেছে প্রতি পাঁচ জনের মধ্যে চার জন। অর্থাৎ, সবমিলিয়ে প্রায় ১০০ কোটি মানুষের আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা প্রকট। পরিসংখ্যান বলছে এখনও পর্যন্ত খাতায় কলমে আক্রান্ত হয়েছেন মাত্র ২ কোটি মানুষ। প্রয়োজনীয় পরীক্ষার অভাবে আড়ালে থেকে গেছে আরও কিছু ঘটনা। তবে বিপর্যয়ের সিংহভাগই যে এখনও সামনে আসেনি, সে কথা আলাদা করে বলার নেই কিছুই। সেই আশঙ্কার কথা ভেবেই সিঁদুরে মেঘ দেখছেন চিকিৎসকরা। ইতিমধ্যেই, দু’লক্ষ ছাড়িয়ে গেছে মৃত্যুমিছিল। আর কত প্রাণহানির সাক্ষী থাকতে হবে ভারতকে, জানা নেই!
Powered by Froala Editor