সাল ১৯৫৪, এপ্রিল মাস। ভারতের প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু’র সঙ্গে চিনের চৌ-এন-লাইয়ের উপস্থিতিতে ভারত ও চিন দুই দেশের মধ্যে তৈরি হয়েছে পঞ্চশীল শান্তিচুক্তি। এই পুরো প্রক্রিয়াটির মূল কেন্দ্রবিন্দু ছিল তিব্বত। দলাই লামা তখন তিব্বতে চিনা আক্রমণের ফলে পালিয়ে আসছেন। ভারত আর চিনের মধ্যে সম্পর্কের পারদ ওঠানামা করছে। এমন পরিস্থিতিতেই এই শান্তিচুক্তি।
ওই সময় দাঁড়িয়ে এই পুরো পরিস্থিতিটা লক্ষ্য করছেন আরও একজন। তিনি বাঙালি পরিচালক, মৃণাল সেন। তখনও তিনি কিংবদন্তি হননি। গোটা সময়ের রাজনৈতিক টালবাহানার দিকে কড়া নজর রাখলেন। বিষয়গুলো নিয়ে ভাবলেন; চারপাশটাকেও দেখলেন। আর সেই প্রেক্ষাপটেই সামনে নিয়ে এলেন নতুন একটি সিনেমা, নতুন একটি গল্প। ‘নীল আকাশের নীচে’। মৃণাল সেনের দ্বিতীয় ছবি, মুক্তি পায় ১৯৫৯ সালে।
গল্প হোক বা সিনেমা— ‘কাবুলিওয়ালা’র সঙ্গে পরিচিত সবাই। এই গল্পটিও একটি ফেরিওয়ালারই গল্প। তবে সে আফগানিস্তান নয়, কলকাতায় এসেছে সুদূর চিন থেকে। ওয়াংলু তার নাম। চিনা সিল্কের কাপড় বিক্রি করতে করতে আলাপ হয় বাসন্তীর সঙ্গে। ওঁর মধ্যে নিজের দিদিকে দেখতে পেল ওয়াংলু। এইভাবেই এগোতে থাকে গল্প। যেখানে ফিরে ফিরে এসেছে দুই দেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ। আর এসেছেন রবীন্দ্রনাথ। ওই সময়ের পরিপ্রেক্ষিতেই ছবিটি তৈরি করা হয়। যেখানে পরতে পরতে চিন আর ভারত নিজেদেরকে ছুঁয়ে গেছে; তৈরি হয়েছে রাজনীতির মঞ্চও…
এই ছবির পেছনে জড়িয়ে আছে নানা গল্প। যারা মৃণাল সেনের সিনেমা মনোযোগ দিয়ে দেখেছেন, তাঁরা জানেন যে মৃণালবাবু খুব বেশি গান ব্যবহার করেননি নিজের সিনেমায়। কিন্তু ‘নীল আকাশের নীচে’-তে দু’দুটি গান ব্যবহৃত হয়েছে। গেয়েছিলেন হেমন্ত মুখোপাধ্যায়। এর পেছনেও রয়েছে একটি গল্প। ছবিটির জন্য কোনো প্রযোজক পাচ্ছিলেন না মৃণাল সেন। তখন সেই বিপদ থেকে রক্ষা করার জন্য এগিয়ে এলেন অনুপকুমার। সম্পর্কে ছিলেন মৃণাল সেনের স্ত্রী’র ভাই। হেমন্ত মুখোপাধ্যায় তখন নিজেরই প্রযোজনা সংস্থা খুলেছিলেন। তো তিনি রাজি হলেন। কিন্তু হেমন্ত মুখোপাধ্যায় মৃণালবাবুকে শর্ত দিয়ে বসলেন। এক, উত্তমকুমারকে নায়ক হিসেবে নিতে হবে। দুই, ছবিতে নায়কের লিপে দুটি গান গাইবেন তিনি। এমন শর্ত মানোট রাজি ছিলেন না মৃণাল।
আরও পড়ুন
মৃণাল সেনের ‘কোরাস’, এক আধুনিক ফ্যান্টাসির সন্ধানে
এই টানাপোড়েনেই ছবিটা তৈরি হওয়া নিয়ে সংশয় তৈরি হল। শেষ পর্যন্ত বিপদ কেটে গিয়েছিল। প্রথমত, ডেট না থাকায় উত্তমকুমার সময় দিতে পারলেন না। পরিবর্তে মৃণাল সেন নায়ক নির্বাচন করলেন কালী বন্দ্যোপাধ্যায়কে। আর গানের ব্যাপারটায় কোনোমতে রাজি হলেন। পরবর্তীতে ‘ও নদীরে’ এবং ‘নীল আকাশের নীচে এই পৃথিবী’— দুটি গানই অমর হয়ে গেছে। অমর হয়েছে সিনেমাটিও। বেরনোর পরই রীতিমতো হিট। কালী বন্দ্যোপাধ্যায় জীবনের সেরা অভিনয়টা বোধহয় এই সিনেমার জন্যই তুলে রেখেছিলেন।
আরও পড়ুন
মৃণাল সেন, সত্যজিৎ রায় ও একটি 'আকাশ কুসুম' বিতর্ক
সিনেমাটির আরও একটি ব্যাপার ছিল মেকআপ। কালী বন্দ্যোপাধ্যায়কে চিনাদের মতো হতে হবে। তার জন্য দরকার উন্নত মেকআপ, প্রস্থেটিক। মৃণাল সেন সোজা চলে গেলেন চেন্নাই। মেকআপ করেছিলেন টলিপাড়ারই শিল্পী শক্তি সেন। সঙ্গে ছিলেন অনন্ত দাস। এই প্রথম একজন পুরুষ চরিত্রের জন্য দুজন মেকআপ ম্যানকে দেখে টালিগঞ্জ। এমনকি, একবার প্রস্থেটিকের সামান্য গণ্ডগোলের জন্য দমবন্ধ হয়ে মারা যাওয়ার মতোও পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল কালী বন্দ্যোপাধ্যায়ের। কোনোক্রমে সে যাত্রা প্রাণ হাতে করে ফিরে এসেছিলেন তিনি। বিশেষ করে এই সিনেমার জন্য মৃণাল সেন আর কালী বন্দ্যোপাধ্যায় দুজনেরই অধ্যাবসায় ছিল দেখার মতো। স্রেফ চিনা আদব-কায়দা, নিয়ম শেখার জন্য টেরিটি বাজারে চলে গিয়েছিলেন দুজন। এক ভদ্রলোকের কাছে পড়ে থেকে শিখেছিলেন সমস্তটা। শুধু কালীবাবুই শেখেননি; শেখেন মৃণালও।
আরও পড়ুন
একসঙ্গে অভিনয় করেও ‘অচেনা’, ঋত্বিক ঘটককে তাড়িয়ে দিলেন উৎপল
সিনেমা মুক্তি পায় ১৯৫৯ সালে। দুই বছর পরই পরিস্থিতি বদলাতে শুরু করে। ভারত আর চিনের মধ্যে তৈরি হয় যুদ্ধ পরিস্থিতি। পরের বছরেই অর্থাৎ ১৯৬২-তে শুরু হয় সেই যুদ্ধ। সেই ইতিহাস, সেই গল্প এক বিস্তৃত অধ্যায়। কিন্তু এর ফলে যেটা হল, সেন্সর বোর্ড ‘নীল আকাশের নীচে’ সিনেমাটির ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। সেই সেন্সার বোর্ডের উপদেষ্টা পদে কে ছিলেন জানেন? সাহিত্যিক তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়। অবশ্য এর বছর দুয়েক পরই সুচেতা কৃপালিনীর চেষ্টায় স্বয়ং জওহরলাল নেহরু ছবিটিকে মুক্ত করান। মৃণাল সেন অবশ্য এসব আমলও দিতেন না। দর্শকদের মধ্যে বিশেষ জায়গা করে নিলেও, সিনেমাটি যে তাঁর আর ভালো লাগে না সেই কথাও বেশ কয়েকবার বলেছিলেন মৃণাল।
আরও পড়ুন
তৈরির ২৫ বছর পর মুক্তি পেয়েছিল প্রথম ছবি, নিজেকে ‘ফ্লপ ডিরেক্টর’ বলতেন ঋত্বিক
তথ্য ঋণ- রোজকার অনন্যা, ‘মৃণাল সেন সংখ্যা’
আরও পড়ুন
দেহ রেখেছেন এই ফ্ল্যাটেই, একবছরের মধ্যেই বিক্রির পথে মৃণাল সেনের ঠিকানা
Powered by Froala Editor