মৃত্যুমিছিলে তৃতীয়, সংক্রমণের নিরিখে প্রথম : করোনার নয়া এপিসেন্টারে ‘স্বাগতম’

সোমবার, গত ২৪ ঘণ্টায় ভারতে আক্রান্ত হলেন সাড়ে ৬৮ হাজার মানুষ। মারা গেলেন ৮১৮ জন। ফলে আক্রান্তের মোট সংখ্যা ৩৭ লক্ষ ছুঁই ছুঁই। অন্যদিকে মৃত্যুর নিরিখে গত রবিবারই মেক্সিকোকে টপকে তৃতীয় স্থানে উঠে এসেছিল ভারত। সেদিনই ২৪ ঘণ্টায় আক্রন্তের সংখ্যাও রেকর্ড গড়েছে বিশ্বে(একদিনে সাড়ে ৭৮ হাজার)। কোনদিকে এগোচ্ছে ভারতের পরিস্থিতি?

পৃথিবীর মধ্যে আক্রান্তের সংখ্যার বিচারে ভারত তৃতীয় স্থানে থাকলেও, সংক্রমণের হারের নিরিখে ভারত এখন পৃথিবীর মধ্যে প্রথম স্থানে। বিশেষজ্ঞরা অধিকাংশই মনে করছেন ভারতই এখন করোনার নতুন এপিসেন্টার। ভারত, যুক্তরাষ্ট্র এবং ব্রাজিলে করোনার প্রথম সংক্রমণ ধরা পড়েছিল প্রায় একই সময়ে। ভারত ছাড়া শীর্ষস্থানীয় দুই দেশেই আক্রান্তের হার অনেকটাই থিতিয়ে এসেছে। কিন্তু ভারতের ক্ষেত্রে তার রেখাচিত্র একেবারেই উল্টোমুখে।

ভারতের ঘিঞ্জি, জনবসতিপূর্ণ শহর অঞ্চলগুলিতেই সংক্রমণ ছড়িয়েছিল প্রথমে। ধীরে ধীরে সেই সংক্রমণের ধারা শহর থেকে সরে গ্রামাঞ্চলের দিকেও। ১৩০ কোটির দেশে বেশিরভাগ মানুষ (প্রায় ৯০ কোটির) বসবাসই যেখানে। পাশাপাশিই গ্রামে শহরের মতো পরিকাঠামো এবং প্রশাসনিক বিভাগ না থাকায় আশঙ্কা বাড়ছে আরও। যেখানে শহরের পরিকাঠামোই সামাল দিতে পাচ্ছে না ভাইরাসের সংক্রমণকে। সেখানে প্রান্তিক অঞ্চলের পরিস্থিতি যে ভয়ঙ্কর হয়ে উঠবে তাতে সন্দেহ কোথায়? 

দিল্লির সাম্প্রতিক করোনা ভাইরাসের অ্যান্টিজেন টেস্টের মধ্যে উঠে আসছে একটি চাঞ্চল্যকর তথ্য। দিল্লিতে করোনা ভাইরাসের অ্যান্টিজেনের অস্তিত্ব মিলেছে আক্রান্তদের প্রায় ৪০ থেকে ২০০ গুণ মানুষের মধ্যে। এই পরিসংখ্যানই প্রমাণ করে দিচ্ছে দিনে ভারতে ৭০-৭৫ হাজারের মতো সংক্রমণ ধরা পড়লেও তার বাস্তব চিত্র পুরোই ভিন্ন। এখনও ঘাটতি রয়েছে পর্যাপ্ত টেস্টের। 

সংক্রমণ আকাশ ছুঁলেও ভারত যে খুব একটা খারাপ অবস্থায় নেই তাই-ই উঠে আসছে প্রশাসনের কথা। যুক্তি হিসাবে বারবার বেছে নেওয়া হচ্ছে মৃত্যুর হারকে। মোট সংক্রমণের নিরিখে মৃত্যুর সংখ্যা ২ শতাংশ বলেই কি নিরাপদ আমরা? ১৩০ কোটির দেশে এখন আক্রান্ত মাত্র ৩৬ লক্ষ মানুষ। যা মোট জনসংখ্যার ১ শতাংশও নয়। তাতেই মৃত্যুর সংখ্যা ছুঁয়েছে ৬৫ হাজার। পরবর্তী সময়ে এই সংখ্যা কোথায় গিয়ে পৌঁছাতে পারে, সেই দিকটাই যেন ভাবা হচ্ছে না। ভাবা ইচ্ছে করেই এড়িয়ে যাওয়া হচ্ছে। ধীরে ধীরে গ্রামাঞ্চলে ভাইরাসের প্রকোপ বাড়লে নিঃসন্দেহে পরিকাঠামো এবং পরীক্ষার অভাবেই বাড়তে থাকবে এই মৃত্যুর হার। রয়েছে এমনটার সম্ভাবনাও।

করোনা ভাইরাসের সংক্রমণকে আয়ত্তে আনার একমাত্র রাস্তা হল লকডাউন। জার্মানি, ইতালি, স্পেনের মতো দেশগুলি যা করে দেখিয়েছে। কিন্তু অর্থনৈতিক কারণের জন্যই দীর্ঘদিন লকডাউন বজায় রাখা কার্যত অসম্ভব, উন্নয়নশীল রাষ্ট্রগুলির ক্ষেত্রে। ব্রাজিল, দক্ষিণ আফিরকা, পেরু, মেক্সিকো তার উদাহরণ। ভারত প্রথম থেকেই লকডাউনের রাস্তাতে হেঁটেছিল। কিন্তু প্রশ্ন থেকেই যায়, সেই লকডাউন কতটা কার্যকরী হল সে-ব্যাপারে। কিছু প্রকল্প নেওয়া হলেও তা শুধু খাতায় কলমেই থেকে গেল কি? এই প্রশ্নই থেকে যায়। একদিকে যেমন সংক্রমণকে আয়ত্তে আনা গেল না, তেমনই ধস নামল অর্থনীতিতেও। 

আরও পড়ুন
শুধুই শহর নয়, ক্রমশ করোনার কোপ বাড়ছে দেশের গ্রামাঞ্চলেও – আতঙ্কিত প্রশাসন

কথায় রয়েছে ‘পরের আগে ঘরের চর্চা করা উচিত’। যেন তেমনটাই হল ভারতের ক্ষেত্রে। গত দু’মাসে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু ছিল ব্রাজিলের অত্যধিক সংক্রমণ। কঠোর সমালোচনার মুখে পড়তে হয়েছিল ব্রাজিল প্রেসিডেন্ট জের বলসোনারোকে। অসাবধানতা, লকডাউন তুলে নেওয়া। সংক্রমণকে ‘সাধারণ ফ্লু’ হিসাবে দেখার জন্যই এই পরিস্থিতির মুখে পড়তে হয়েছিল ব্রাজিলকে। ভারতও কি আজ সেই জায়গাতেই যাচ্ছে না?

৭ সেপ্টেম্বর থেকেই আনলকের চতুউর্থ পর্বের শুরুয়াত। আগে থেকেই কেন্দ্র জানিয়ে দিয়েছে রাজ্যগুলিকে এবার থেকে লকডাউন করতে গেলে অনুমতি নিতে হবে কেন্দ্রের থেকে। শুধুমাত্র কন্টেনমেন্ট জোনগুলিতেই এবার থেকে লকডাউন থাকবে। সংক্রমণের শিখরে যেতে যেতে খেলাটা এভাবেই ঠিক পাল্টে গেছে। যেখানে শুরুর দিকে বাস, অটো চালানোর জন্য অনুমতি নিতে হচ্ছিল রাজ্যগুলিকে। এখন ঠিক তার উল্টোটাই চলছে। 

গণপরিবহণের মধ্যে ট্রেন-মেট্রো চলতেও দেরি নেই খুব বেশি। কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষার মহড়াও শুরু হয়ে গেছে দেশজুড়ে। ভারতের ভাগ্যকে অনেকটাই দৈবের হাতে ছেড়ে দিয়েই আপাতত নিশ্চিন্ত সকলে। বালির মধ্যে মুখ গুঁজে ভরসা রেখে যাওয়া, ‘ভ্যাকসিন আসবেই আসবে’...

আরও পড়ুন
দেশের মোট করোনা-আক্রান্ত স্বাস্থ্যকর্মীদের ৭৪ শতাংশই ৬টি রাজ্য থেকে, ক্ষুব্ধ চিকিৎসকরা

(মতামত লেখকের ব্যক্তিগত)

Powered by Froala Editor

More From Author See More