রাজনীতি নাক গলিয়েছে খেলার ময়দানে আগেই। দীর্ঘদিন ভারত-পাকিস্তানের ক্রিকেটপ্রেমী দর্শকের তাই হাপিত্যেশ করা ছাড়া উপায় বিশেষ কিছু নেই এখন। অথচ, ‘ভারত বনাম পাকিস্তান’— এই শব্দবন্ধই অবিরাম দোলা লাগিয়েছে কত মনে! বর্ডারের দুই পারে রাজনৈতিক বিদ্বেষের ছবিটা যতই ঘোলাটে হোক না কেন, একে অপরের বিরুদ্ধে খেলতে নামলেই বুকে ধুকপুকুনি নিয়ে দুই পারের দর্শকদের টিভির সামনেই কেটে যেত কত কত ক্রিকেট বেলা।
মহাজাগতিক উত্তেজনা কিছু কম উপহার দিয়ে যায়নি এই প্রতিদ্বন্দ্বিতা। মহাতারকার জন্মও হয়েছে একাধিক। কিন্তু মাঠে যতই উত্তেজনা থাকুক না কেন, মাঠের বাইরের সম্পর্কটা ছিল দুই চেনা-পরিচিত প্রতিবেশীর মতোই। ঘটেছে এমনকি একসঙ্গে হোলি খেলার মতো ঘটনাও!
১৯৮৭। ক্রিকেট রোমান্টিকের ভোলার কথা নয় এই বছরটা। ভারতের মাটিতে বিশ্বকাপ। ইডেন উদ্যানে ফাইনাল। ‘রিভার্স সুইপ’ নামের একটা শটের একাধারে হিরো এবং ভিলেন হয়ে যাওয়া এবং মিস্টার সুনীল মনোহর গাভাস্কারের শেষ টেস্ট ম্যাচ। বিপক্ষে, ইমরান খানের পাকিস্তান।
ধুলো ওড়া পিচ। সাড়ে পাঁচ ঘণ্টার যুদ্ধ। ২৬৪ বল খেলে স্কোরবোর্ডে রানের সংখ্যা ৯৬। তবু ক্রিকেট পণ্ডিত থেকে শুরু করে দেশ-বিদেশের বহু ক্রীড়াপ্রেমীই সেই ইনিংসটাকে বসিয়েছেন সর্বকালের অন্যতম সেরার আসনে। নিদেনপক্ষে স্পিনের বিরুদ্ধে খেলা সেরা ইনিংস বলতে দ্বিধা নেই প্রায় কারুরই।
কিন্তু সেটা ছাড়াও আরও একটা কারণে উজ্জ্বল হয়েছিল সেই টেস্ট ম্যাচ। সেটা এমনই একটা সময়, যখন ভারত-পাকিস্তানের খেলা থাকলে বিমানে ক্যাপ্টেন মাঝেমধ্যেই জানিয়ে দিতেন স্কোর আপডেট! প্রথম ইনিংসে প্রথমে ব্যাট করে পাকিস্তান গুটিয়ে গেছে মাত্র ১১৬ রানে। জবাবে ব্যাটিং করতে নেমে ভারত লিড নিল ২৯ রানের। দ্বিতীয় ইনিংসে পাকিস্তানের রান ২৪৯। মাত্র ২২১ রানের লক্ষ্যমাত্রা সামনে। দলে তখন গাভাস্কার ছাড়াও কৃষ্ণমাচারি শ্রীকান্ত, মহিন্দর অমরনাথ, দিলীপ ভেঙ্গসরকার, রজার বিনি, রবি শাস্ত্রী, নবাগত মহম্মদ আজহারউদ্দিন কিংবা কপিল দেবের মতো তারকা। উল্টোদিকে ইমরানের সঙ্গে আশ্চর্য এক প্রতিভা, যাকে খুজে এনেছেন পাক অধিনায়ক স্বয়ং— ওয়াসিম আক্রাম। তা সত্ত্বেও প্রথম ইনিংসে ভারতের দশটা উইকেট নিয়েছিলেন পাক দলের দুই স্পিনার, ইকবাল কাসিম এবং তৌসিফ আহমেদ।
মজার ব্যাপারটা ঘটল এসবের মাঝেই। তখন নিয়ম অনুযায়ী পাঁচ দিনের খেলার মাঝে থাকত একদিনের ‘রেস্ট ডে’। সাধারণত তিন দিনের পরেই এই ‘রেস্ট ডে’ থাকার নিয়ম হলেও, সেবার বাধ সাধল দোল উৎসব। দোল উৎসবের জন্যই সেই ম্যাচে খানিকটা বদলানো হয়েছিল ‘রেস্ট ডে’র নিয়ম। দোলের দিন ছুটি দিতে, টেস্টের চার নম্বর দিনের পরের দিন নির্ধারিত হয়েছিল ‘রেস্ট ডে’।
তার আগে কখনোই হোলি খেলেনি পাকিস্তান দল। ব্যাঙ্গালোরের ওয়েস্টিন হোটেলে একই সঙ্গে ছিল দুই দলের থাকার ব্যবস্থা। মাঠে ভারতীয় দল বিপাকে পড়লেও, দোলের দিন সকালে রেহাই পেলেন না পাক দলের খেলোয়াড়েরা। যতদূর শোনা যায়, শুরুটা হয়েছিল আবির দিয়ে এবং ভোর চারটের সময় থেকেই। আবির থেকে বাদুড়ে রঙে যেতে সময় লাগেনি খুব বেশি। ঐতিহ্যবাহী ওয়েস্টিন হোটেলের ভিতর থেকে সুইমিং পুল অবধি পুরোটাই লাল হয়ে গিয়েছিল দুই দলের খেলোয়াড়দের রং খেলার উন্মাদনায়।
শোনা যায়, এর জন্য বেশ বড়সড় ক্ষতিপূরণ চেয়ে বিল পাঠানো হয়েছিল ভারতীয় বোর্ডের কাছে। বিসিসিআই প্রেসিডেন্ট তখন শ্রী জগমোহন ডালমিয়া। স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিতেই পরিস্থিতি সামাল দিয়েছিলেন প্রবাদপ্রতিম ক্রিকেট প্রশাসক। এই নিয়ে একদমই জল ঘোলা হয়নি আর পরবর্তীতে।
সেই সময় পাক দলের অধিনায়ক হওয়ার কারণে ক্যাপ্টেনদের জন্য নির্ধারিত কটেজে ছিলেন ইমরান। রঙের এই তাণ্ডবলীলা থেকে তিনি বাঁচতে পেরেছিলেন কিনা, সে নিয়ে দ্বিমত আছে যদিও। প্রখ্যাত সাংবাদিক কিশোর ভিমানি এবং তার পুত্র গৌতম ভিমানিও একই হোটেলে ছিলেন সেই সময়। তাঁদের কথা অনুযায়ী, ইমরানকে ভুলিয়ে-ভালিয়ে ঘর থেকে বের করতে সাহায্য করেছিলেন পাক দলের খেলোয়াড়েরাই। তারপর রঙে ভর্তি সুইমিং পুলে ছুড়ে ফেলা হয়েছিল প্রবাদপ্রতিম অলরাউন্ডারকে। অন্যদিকে সেই সময় ভারতীয় দলের উইকেটকিপার কিরণ মোরে একটি সাক্ষাৎকারে জানিয়েছিলেন, জাভেদ মিয়াঁদাদের মতো ‘বিশ্বস্ত সেনা’র ডাকেও ভোলেননি ইমরান; কিছুতেই বের করা যায়নি তাঁকে ঘর থেকে।
পঞ্চম দিনের খেলায় দেখা গিয়েছিল পাক দলের দুই স্পিনার লাল রংয়ের তালু নিয়ে বল করে চলেছেন লাগাতার। এবং সেই উদ্দাম দিনের পরের দিনেই ধৈর্যের আরেক নাম লেখা হবে, সুনীল মনোহর গাভাস্কার। ক্রিকেট বিশ্ব যাকে সেই শেষবারের মতো দেখবে লাল বলের টেস্ট ক্রিকেটে ব্যাট হাতে মাঠে নামতে।
Powered by Froala Editor