বিশ্বের প্রথম স্টেরয়েড-মুক্ত গর্ভনিরোধক বড়ি, নেপথ্যে এক ভারতীয়!

কিছুদিন আগেই প্রকাশিত হয়েছিল রাষ্ট্রপুঞ্জের জনসংখ্যা রিপোর্ট। ভারতের বাড়তে থাকা জনঘনত্ব নিয়ে সেই রিপোর্টে রীতিমতো আশঙ্কা প্রকাশ করেছিলেন বিশেষজ্ঞরা। অনুমান, ২০৫০ সালের মধ্যেই চিনকে টপকে জনসংখ্যার তালিকায় ১-এ উঠে আসবে ভারত। কাজেই জনসংখ্যা এবং জন্মহার নিয়ন্ত্রণে ভারতকে সক্রিয় পদক্ষেপ নিতে হবে, তাতে সন্দেহ নেই কোনো। তবে আশ্চর্যের বিষয় হল, বিশ্বের মধ্যে প্রথম দেশ হিসাবে জন্মহার নিয়ন্ত্রণের নীতি প্রণয়ন করেছিল ভারত। এমনকি ভারতেই তৈরি হয়েছিল বিশ্বের প্রথম স্টেরয়েড মুক্ত গর্ভনিরোধক বড়ি।

‘সহেলি’ (Saheli)। ১৯৯৫ সালে জাতীয় পরিবার পরিকল্পনা কর্মসূচির অধীনে চালু হয়েছিল এই বিশেষ গর্ভনিরোধক বড়ির (Contraceptive Pill) ব্যবহার। যা ভারত তো বটেই, বিপ্লব এনেছিল গোটা বিশ্বের চিকিৎসা জগতে। আর এই আশ্চর্য ঔষধির নেপথ্যে রয়েছেন লখনৌ-এর সেন্ট্রাল ড্রাগস রিসার্চ ইনস্টিটিউটের গবেষক ও জৈব-রসায়নবিদ ডাঃ নিত্য আনন্দ (Nitya Ananda)। 

১৯৯৫ সালে এই বড়ির ব্যবহার শুরু হলেও, তা তৈরির গবেষণা শুরু হয়েছিল অন্ততপক্ষে আরও দু’দশক আগে। অবশ্য গর্ভনিরোধক বড়ি তখনও পাওয়া যেত বাজারে। ১৯৫১ সালে অস্ট্রেলিয়ান বংশোদ্ভূত মার্কিন গবেষক কার্ল জেরাসি হাত ধরেই বাজারে এসেছিল বিশ্বের প্রথম কন্ট্রাসেপ্টিভ পিল। সফলভাবে ডিম্বাশয় থেকে ডিম্বাণুর ক্ষরণ বন্ধ করে দিতে সক্ষম হলেও, একাধিক পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেখা যেত এই ড্রাগের প্রভাবে। দেখা যেত অনিয়ন্ত্রিত ঋতুস্রাবের ঘটনা। আর তার প্রধান কারণ ছিল এই ওষুধে স্টেরয়েডের উপস্থিতি। 

বিশ্বের অন্যত্র জনপ্রিয়তা পেলেও, এই কারণে ভারত সরকার সেভাবে প্রচার করেনি এই কন্ট্রাসেপ্টিভ পিলের। বদলে আভাবাঈ ওয়াদির নেতৃত্বাধীন ভারতের জাতীয় পরিবার পরিকল্পনা  কমিশন শুরু করেছিল বিকল্পের অনুসন্ধান। ১৯৬০-এর দশকের শুরুর দিক সেটা। ডঃ নিত্য আনন্দ এবং ডঃ ভেঙ্কটরমনের সঙ্গে আলোচনায় বসে প্ল্যানিং কমিশন। এই দুই গবেষকের কাঁধেই দেওয়া হয়েছিল গবেষণার দায়িত্ব।

না, কোনো কৃত্রিম পদ্ধতিতে রাসায়নিক নির্ণয় নয়। ডঃ আনন্দের প্রথম লক্ষ্য ছিল, প্রাণীদেহে উপস্থিত হরমোনের আনুপাতিক পরিবর্তন ঘটিয়ে গর্ভনিরোধের প্রক্রিয়াকে ত্বরান্বিত করা। সেই বিষয়ে গবেষণা করতে গিয়েই তাঁর নজরে আসে ইথামক্সিট্রিপথল নামের একটি বিশেষ উৎসেচকের উপস্থিতি। এই বিশেষ উৎসেচক প্রাকৃতিক গর্ভনিরোধক হিসাবে কাজ করে প্রাণীদেহে। অর্থাৎ, এই উৎসেচকের উপস্থিতির কারণেই, যৌনমিলনের ফলে অনেকক্ষেত্রে গর্ভধারণ ব্যর্থ হয় প্রাণীদের। বিশ শতকের শুরুর দিকেই একাধিক গবেষণা হয়েছিল এই বিষয়টি নিয়ে। সেই গবেষণাপত্রগুলিই হাতিয়ার হয়ে ওঠে আনন্দের। এই বিশেষ উৎসেচককেই মানবদেহের উপযোগী করে তোলাই ছিল তাঁর প্রধান লক্ষ্য। 

এই পরিকল্পনাকে বাস্তবের রূপ দিতে সময় লেগেছিল এক দশক। ১৯৭১ সালেই প্রকাশ্যে আসে ‘সেন্টক্রোমান’ নামের এই ওষুধ। শুরু হয় ট্রায়াল। মানুষ নয়, বরং বানর, ইঁদুর ও খরগোশের মতো প্রাণীর দেহে স্বল্পমাত্রায় প্রবেশ করানো শুরু হয় এই রাসায়নিকটি। সে-সময় বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংবাদপত্রেও জায়গা করে নিয়েছিল এই সংবাদ। তবে এই গবেষণা সফল হবে না, তেমনটাই ধরে নিয়েছিলেন গবেষকদের একাংশ। 

দীর্ঘ দু’দশকের ট্রায়াল এবং ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের পর ১৯৯০-এ ভারত সরকারের মান্যতা পায় এই ওষুধ। বছর পাঁচেক পর ১৯৯৫ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে ‘সহেলি’ নামে এই ওষুধকে গর্ভনিরোধক বড়ি হিসাবে নীতিমালায় হাজির করে ভারতের ফ্যামিলি-প্ল্যানিং কমিশন। অবশ্য আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পেতে সময় লেগেছে আরও। নব্বই-এর দশকের শেষ দিকে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বিশ্বের প্রথম স্টেরয়েডমুক্ত গর্ভনিরোধকের তকমা দেয় এই ওষুধকে। 

তবে এই যুগান্তকারী আবিষ্কারের পরেও কজনই বা মনে রেখেছে পদ্ম-প্রাপক ডাঃ আনন্দের কথা? কজনই বা মনে রেখেছে তাঁর ‘পূর্বজীবন’-এর সংগ্রাম? আসলে বর্তমান পাকিস্তানের ফয়সালাবাদে জন্ম হয়েছিল ডাঃ নিত্য আনন্দের। দেশভাগের সময় গ্রাম উজাড় করে, পশ্চিম পাকিস্তানের মানুষজন এদেশে চলে আসলেও, চিকিৎসকের অভাব পূরণ করতে পাকিস্তানে থেকে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন তিনি। তবে শেষ পর্যন্ত দেশ-স্বাধীনের সপ্তাহ খানেক আগে তাঁকে উচ্ছেদ করা হয় সেখান থেকে। বিধবা মা-কে নিয়ে উঠে এসেছিলেন লখনৌ-এ। এদেশে এসেও শুরু করেন জনকল্যানমূলক কাজ। অস্থির সময়ে দরিদ্র মহিলাদের হস্তশিল্পের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করেছিলেন তিনি। সেইসঙ্গেই গবেষণা শুরু করেন দিল্লির ইউনিভার্সিটি ডিপার্টমেন্ট অফ কেমিক্যাল টেকনোলজিতে। ডঃ ভেঙ্কটরমনের সঙ্গে তাঁর সাক্ষাৎ সেখানেই। এমনকি ‘নিত্যানন্দ’ থেকে তাঁর নাম বদলে ‘নিত্য আনন্দ’ করে দিয়েছিলেন স্বয়ং ভেঙ্কটরমন। কন্ট্রাসেপ্টিভ পিল তৈরি গবেষণার ভারও ডঃ আনন্দের হাতে তুলে দিয়েছিলেন তিনিই। তবে শুধু ‘সহেলি’-র গবেষণাই নয়, একইসঙ্গে নিরোধক সম্পর্কে সচেতনতাবৃদ্ধি ও অন্যান্য গবেষণায় সক্রিয় ভূমিকা রয়েছে ডঃ আনন্দের। বলতে গেলে, তাঁর আবিষ্কারের সৌজন্যেই আজও বিপুল জনপ্লাবনের থেকে একধাপ দূরে দাঁড়িয়ে ভারত… 

Powered by Froala Editor