মাথায় শুধু হাতুড়ি পেটার শব্দ! রহস্যময় ‘হাভানা সিন্ড্রোমে’ আক্রান্ত মার্কিন গোয়েন্দারা

কোথাও কোনো শব্দ নেই। কিন্তু মাথার মধ্যে যেন সারাক্ষণ মশলা পেষাইয়ের শব্দ হচ্ছে। দু-কান ঢাকা দিলেও সেই শব্দের হাত থেকে রেহাই নেই। বিগত কয়েক বছর ধরে বিষয়টা নিয়ে রীতিমতো চিন্তিত হয়ে পড়েছে মার্কিন প্রশাসন। কারণ অদ্ভুত এই রোগের শিকার প্রত্যেকেই মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থার কর্মচারী। অনেকেই আবার উচ্চপদস্থ। ইতিমধ্যে রোগটির একটি নামও দেওয়া হয়েছে। হাভানা সিন্ড্রোম (Havana Syndrome)। কিন্তু আদৌ কী এই রোগ, কীভাবেই বা এই রোগের সৃষ্টি – সেসব প্রশ্নের উত্তর এখনও ধোঁয়াশায় ঢাকা।

ঘটনার শুরু ২০১৩ সালে। কিউবার হাভানা শহরের মার্কিন দূতাবাসে রয়েছেন এক সিআইএ গুপ্তচর। হঠাৎই তিনি শুনতে শুরু করলেন, তাঁর কানের ঠিক পাশে কেউ যেন হাতুড়ি পেটাই করছে। অথচ আশেপাশে কোথাও কিছু নেই। কিছুদিন এরকম চলার পরেই শুরু হল অসহ্য মাথাব্যথা। সঙ্গে সঙ্গে আমেরিকায় ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়া হল তাঁকে। কিন্তু সেখানে গিয়েও কোনো সুফল হল না। তখনও তাঁর কানে বেজে চলেছে একইরকম হাতুড়ি পেটার শব্দ। এমনিতে সিআইএ চরদের কোনো খবর বাইরে বের করা যায় না। চিকিৎসার কাজও করেন গোপন ডাক্তাররাই। কিন্তু এখানে যে জীবন মরণ সমস্যা। ফলে সব তথ্য গোপন রাখা সম্ভব হল না কিছুতেই।

একজনের হলে হয়তো তাও গোপন রাখা যেত। কিন্তু দেখতে দেখতে কিউবায় কর্মরত মার্কিন গোয়েন্দাদের মধ্যে মহামারীর মতো ছড়িয়ে পড়ে রোগ। ২ বছরের মধ্যে ২৬ জন আক্রান্ত হন অদ্ভুত এই রোগে। হাভানা শহর থেকে রোগের প্রাদুর্ভাব। তাই লোকমুখে রোগের নাম হয়ে যায় হাভানা সিন্ড্রোম। ধীরে ধীরে নানারকমের গুজবও ছড়িয়ে পড়তে থাকে চারিদিকে। অনেকের ধারণা হয়, মার্কিন গুপ্তচরদের প্রতিরোধ করতে কিউবার বিজ্ঞানীরাই এই আশ্চর্য পদ্ধতি আবিষ্কার করেছে। কিন্তু ২০১৫ সাল নাগাদ আমেরিকার সঙ্গে কিউবার বৈদেশিক সম্পর্ক উন্নত হলেও এই রোগের প্রকোপ কমে না। ইতিমধ্যে আমেরিকার বিজ্ঞানীরাও বিষয়টি নিয়ে গবেষণা শুরু করে দিয়েছেন।

ইলিনয় ইউনিভার্সিটির গবেষক জেমস লিন এই রোগের কথা শোনার সঙ্গে সঙ্গেই বিষয়টির সঙ্গে মাইক্রোওয়েভ তরঙ্গের যোগসূত্রের কথা বলেন। তাত্ত্বিক প্রমাণের পাশাপাশি তাঁর কাছে ছিল একেবারে প্রত্যক্ষ প্রমাণ। কারণ ঠান্ডা যুদ্ধের সময় তিনি নিজেও আক্রান্ত হয়েছিলেন এমন রোগে। অবশ্য সেটা এতটা ভয়াবহ হয়ে ওঠেনি। জেমস লিন জানিয়েছেন, তিনি একা নন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় থেকেই বহু মার্কিন সৈনিক এই রোগে আক্রান্ত হয়েছেন। বিশেষত যাঁরা রাশিয়ায় গুপ্তচরের কাজ করতে গিয়েছিলেন। এই সময় একটি পরীক্ষা করে লিন প্রমাণ করেছিলেন, মস্তিষ্কের মধ্যে এমন শব্দের জন্মের সঙ্গে মাইক্রোওয়েভ তরঙ্গের সম্পর্ক রয়েছে। মাইক্রোওয়েভ তরঙ্গ দিয়ে মস্তিষ্কে এমন অনেক তথ্য পাঠানো সম্ভব, বাস্তুবে যার কোনো অস্তিত্ব নেই।

আরও পড়ুন
যৌন নির্যাতনের পিছনে ‘পিটার প্যান সিনড্রোম’! কী বলছেন মনোবিদরা?

সংবাদ সংস্থা বিবিসির সূত্রে জানা গিয়েছে, ঠান্ডা যুদ্ধের সময় রাশিয়ার বিজ্ঞানীরা মাইক্রোওয়েভকে কাজে লাগিয়ে অস্ত্র তৈরির পরিকল্পনাও করেছিলেন। কিছু ব্যাঙের উপর মাইক্রোওয়েভ তরঙ্গ প্রয়োগ করে দেখা যায়, এর ফলে তাদের হৃৎপিণ্ডও বিকল হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত এমন কোনো অস্ত্র তৈরি হয়েছিল বলে জানা যায় না। ইতিমধ্যে অবশ্য কিউবার সীমানা ছাড়িয়ে রোগের বিস্তার ঘটে গিয়েছে বহুদূর। ২০১৭ সালে রাশিয়ায় কর্তব্যরত কিছু গোয়ান্দাও একইরকম শব্দ শুনতে পান। ২০১৮ সালে আক্রান্ত হন চিনে কর্তব্যরত এক গোয়েন্দা। ফলে মাইক্রোওয়েভ অস্ত্রের ধারণা যদি সত্যি হয়, তাহলে বলতে হয় আমেরিকার বিরুদ্ধে এক আন্তর্জাতিক চক্রান্ত চলছে।

আরও পড়ুন
ডাউন সিনড্রোমকে হারিয়ে আন্তর্জাতিক খ্যাতি তরুণ ফটোগ্রাফারের

অন্যদিকে আক্রান্তদের অনেকেই অভিযোগ তুলছেন খোদ মার্কিন সরকারের বিরুদ্ধেই। তাঁদের মতে, আমেরিকাই আসলে মাইক্রোওয়েভ অস্ত্র তৈরির পরিকল্পনা চালিয়ে যাচ্ছে। আর এই কাজের জন্য গিনিপিগ হিসাবে ব্যবহার করছে নিজের দেশের গোয়েন্দাদেরই। অন্যদিকে বেশ কিছু গবেষকের মতে, পুরোটাই আসলে মানসিক সমস্যা। সবসময় যুদ্ধের পরিকল্পনার মধ্যে থাকতে থাকতে মাথায় চাপ পড়ছে গোয়েন্দাদের। আর তার ফলেই স্নায়বিক স্বাস্থ্য বিঘ্নিত হচ্ছে। এখনও অবধি কেউই জানেন না হাভানা সিন্ড্রোমের উৎস কোথায়। কীভাবে সুস্থ হয়ে উঠবেন আক্রান্তরা, অজানা তাও।

Powered by Froala Editor

Latest News See More