‘ধ্বংসেই শিল্পের সার্থকতা’, নিজের তৈরি মূর্তিতেই আগুন ধরিয়েছিলেন এই শিল্পী!

/৯

সময়টা ২০১১ সাল। শিল্পের জগতে সেবার আগুন লাগিয়ে দিয়েছিলেন সুইৎজারল্যান্ডের শিল্পী উর্স ফিশার (Urs Fischer)। না, আলঙ্কারিক অর্থে নয়। আক্ষরিক অর্থেই তাঁর প্রদর্শনীতে অগ্নিকাণ্ড ঘটেছিল। এবং তাই ছিল শিল্পীর উদ্দেশ্য। তাঁর তৈরি প্রতিটি মূর্তিই ছিল এক একটি মোমবাতি (Candle)।

/৯

দর্শকরা কিন্তু কেউই কিছু জানতেন না। তাঁরা শুধু জানতেন মূর্তিগুলি মোমের তৈরি। কেউ কেউ বেশ কাছে গিয়েই দেখে আসছিলেন মূর্তিগুলিকে। আর তারপর একে একে এসে বসছিলেন প্রদর্শশালার সামনে রাখা চেয়ারে। কারণ শিল্পী তাঁর নিজের সৃষ্টি ব্যাখ্যা করবেন নিজে। এমনটা সচরাচর প্রদর্শনীতে হয় না।

/৯

উর্স ফিশার তাঁর শিল্পের ব্যাখ্যার জন্য কোনো বক্তৃতা দেননি। বদলে এক একটি মোমবাতিতে আগুন ধরিয়ে দিয়েছিলেন। আর দেখতে দেখতে সমস্ত মূর্তি গলে যেতে শুরু করল। হতবুদ্ধি দর্শকরা বসে থাকলেন মন্ত্রমুগ্ধের মতো। যতক্ষণ প্রতিটা মূর্তি গলে না যাচ্ছে, ততক্ষণ কেউই হল থেকে বেরিয়ে আসেননি।

/৯

প্যারিসের বুর্স ডি কমার্স প্রেক্ষাগৃহে সেদিন এক অদ্ভুত মুহূর্তের সাক্ষী ছিলেন সকলে। এতক্ষণ যে শিল্পকর্ম দেখে তাঁরা মুগ্ধ হচ্ছিলেন, তাতে আগুন ধরিয়ে দিলেন শিল্পী স্বয়ং। শুধু তাই নয়, তিনি বললেন এই আগুন নিভলে তবেই তাঁর সৃষ্টি সম্পূর্ণ হবে। এতক্ষণ তাঁরা যা দেখছিলেন, তা কেবল খসড়ামাত্র। আসলে এই পৃথিবী যেমন প্রতিদিন ধ্বংসের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে, তেমনই ধ্বংস হতে হবে সমস্ত শিল্পকেও। সেখানেই শিল্পের সার্থকতা।

/৯

প্রেক্ষাগৃহের মাঝের পুরো জায়গাটাই সাজানো ছিল মোমের মূর্তি দিয়ে। তার কেন্দ্রেই ছিল ষোড়োশ শতকের বিখ্যাত ভাস্কর্য ‘অ্যাবডাকশন অফ দি স্যাবাইন ওম্যান’-এর একটি অসাধারণ অনুকৃতি। তাকে ঘিরে রাখা কতগুলি চেয়ার। কোনোটা প্লাস্টিকের চেয়ারের মতো, কোনোটা অফিসের ঘোরানো চেয়ার, কোনোটা বিমানবন্দরে অপেক্ষা করার চেয়ার। আর সব চেয়ারে বসে থাকা মানুষগুলো তাকিয়ে আছে মাঝের মূর্তিটির দিকে। যেখানে একজন নারীকে অপহরণ করে নিয়ে যাচ্ছে এক পুরুষ।

/৯

এইসব চরিত্রগুলোর মধ্যে একজন দাঁড়িয়ে ছিলেন। পকেটে হাত গুঁজে চশমাটা মাথার উপর তুলে গভীরভাবে দেখছিলেন অপহরণের ঘটনা। যেন তাঁর নির্দেশেই ঘটছে এমন একটা অপরাধ। আর বাকিরাও কিন্তু সব দেখে নিশ্চুপ। তাঁরাও কি একই দোষে দোষী নন? যেন এই প্রশ্নটাই উস্কে দিতে চাইছিলেন ফিশার।

/৯

এই মেরুদণ্ডহীন সমাজটার বুকেই আগুন ধরিয়ে দিতে চেয়েছিলেন ফিশার। আর সেটাই করে দেখালেন তাঁর শিল্পের ভিতর দিয়ে। দর্শকদের চোখের সামনে সমস্ত মূর্তি যখন গলে গেল, তখনও মোমের পরিমাণটা কিন্তু একই থেকে গেল। শুধু সেই মোম গলে গলে নিজের মতো চেহারা নিয়েছে। তাকে বানিয়ে তোলা নয়। আর ফিশারের মতে, এটাই তাঁর শিল্প।

/৯

এরপর অবশ্য ভাস্কর্যের জগৎ থেকে নিজেকে পুরোপুরি গুটিয়ে নিয়েছিলেন ফিশার। গত ১০ বছর ধরে তিনি চিত্রশিল্পের দিকেই নজর দিয়েছেন। তবে এখনও ইউরোপজুড়ে মানুষ তাঁকে চেনেন সেদিনের সেই অভিনব প্রদর্শনীর জন্যই। প্রদর্শশালায় ভিড় তো ছিলই, তার চেয়েও বেশি মানুষ সেদিনের ঘটনা শুনেছিলেন অথবা সংবাদপত্রে পড়েছিলেন। সকলেই একইরকম বিস্মিত হয়েছিলেন।

/৯

অনেকেই হয়তো আবার সেই মুহূর্তের সাক্ষী হতে চেয়েছিলেন। কিন্তু ফিশার আর এরকম প্রদর্শনীর জন্য রাজি হননি। এর মধ্যেই হঠাৎ সুখবর নিয়ে এল বুর্স ডি কমার্স কর্তৃপক্ষ। হঠাৎ একটি বিজ্ঞাপনে জানালেন, ফিশারের প্রদর্শনীর পর সেই ঘরটি একইভাবে সংরক্ষণ করে রাখা হয়েছে। এখনও সেখানে জমাট বেঁধে আছে মোমের স্তর। আর আবারও সেই ঘরে শুরু হয়েছে প্রদর্শনী। সেই আপাত ধ্বংসস্তূপ দেখতেই ভিড় করছেন নানা দেশের মানুষ। ২০২১ সালের শেষদিন পর্যন্ত চলবে এই প্রদর্শনী।

Powered by Froala Editor