সিরাজের ভয়েই লুকনো অজস্র ধনসম্পদ! মুর্শিদাবাদের প্রাসাদ ও মুখে রক্ত ওঠার ‘গল্প’

নবাব সারফরাজ খাঁ গিরীয়ার যুদ্ধে পরাজিত। মুর্শিদাবাদের নতুন নবাব তখন আলিবর্দী খাঁ। মসনদে বসেই আলিবর্দি মুর্শিদাবাদে ডেকে নিলেন প্রিয় কন্যা মেহের-উন-নিশা বেগম বা ঘসেটি বেগমকে। সঙ্গে এলেন জামাতা  ঢাকার দেওয়ান নওয়াজিস মোহাম্মদ শাহমত জং-ও। মুর্শিদকুলি তৈরি করে দিলেন এক সুরম্য প্রাসাদ। যা 'সাঙ্গ-ই-দালান' নামে পরিচিত ছিল। এই প্রাসাদের পাশেই কাটা হল একটি সুন্দর ঝিল।এই ঝিল নির্মিত হয়েছিল সৌন্দর্য বৃদ্ধির পাশাপাশি নিরাপত্তা জনিত কারণেও। কারণ নবাব আলিবর্দির রাজত্বকালেই বাংলায় বর্গীরা হানা দিয়েছিল। যাইহোক দেওয়ান নাওয়াজিস মোহাম্মদের ছিল মোতি ওরফে মুক্তো চাষের শখ, সেই ইচ্ছে পূরণের জন্য প্রাসাদ সংলগ্ন ঝিলেই শুরু হল মোতি চাষ। ফলে মোতির নামেই সমগ্র অঞ্চলটি পরিচিতি পেল মতিঝিল নামে।

মতিঝিল ছিল রাজধানীর সমস্ত কোলাহল মুক্ত এক শান্ত এলাকা। এই মনোরম পরিবেশে ঘসেটি বেগম ও নাওয়াজেস মোহাম্মাদ তাদের পালিত পুত্র একরাম-উদ-দৌলার সঙ্গে বেশ সুখে শান্তিতেই বসবাস করছিলেন। কিন্ত পলাশীর যুদ্ধের আগে এই শান্ত এলাকাই গরম হয়ে উঠল সিরাজ বিরোধী ষড়যন্ত্রে। খবর পেয়ে নবাব সিরাজ একদিন হঠাৎ করেই মতিঝিল আক্রমণ করে বসলেন। মাসি ঘসেটি বেগমকে গৃহবন্দি করে রাখলেন চেহেলসেতুন প্রাসাদে। ইতিপূর্বেই কোনো এক আকস্মিক রোগে ভুগে মৃত্যু হয়েছে ঘসেটি বেগমের পালিত পুত্র ও স্বামীর। ফলে পরিত্যক্ত মতিঝিলের দখল নিলেন তরুণ নবাব সিরাজ-উদ-দৌলা। এবং সেখানেই তিনি মেতে ওঠেন বিলাসী জীবনে। এই মতিঝিলের সৌন্দর্য দেখেই নবাব ঈর্ষান্বিত হয়ে নাকি তার হিরাঝিল প্রাসাদ তৈরি করেছিলেন বলে কথিত রয়েছে।

এদিকে এর মধ্যেই এসে পড়ল পলাশির যুদ্ধের সেই অশুভ দিন। জনশ্রুতি বলে, নবাব সিরাজ নাকি এই মতিঝিল প্রাসাদ থেকেই পলাশীর প্রান্তে রওনা হয়েছিলেন যুদ্ধের উদ্দেশ্যে। কিন্ত পরাজিত নবাব মতিঝিলে আর ফেরেননি। ঘসেটি বেগমেরও আর ফেরা হয়নি তাঁর স্বপ্নের প্রাসাদে। ফলে তখন থেকেই চারিদিকে একটি গুজব রটে যায় ঘসেটি বেগমের বিপুল ধনসম্পদ সোনা-দানা, হীরা-জহরত সর্ম্পকে। কারণ ঘসেটি বেগম ছিলেন প্রচুর ধনসম্পত্তির অধিকারী। ফলে খুব স্বাভাবিক ভাবেই প্রশ্ন ওঠে, ঘাসেটি বেগমের এত ধনসম্পত্তি কোথায় গেল? এই প্রশ্নের উত্তর আজও সবার অজানা। কারো মতে নবাব সিরাজ সেগুলি লুন্ঠন করে হীরাঝিল প্রাসাদে নিয়ে গিয়েছিলেন। পরবর্তীতে সেই সম্পদ মীরজাফরের হাতে পড়ে এবং তিনি নাকি সেগুলি পলাশীর যুদ্ধের ষড়যন্ত্রীদের সঙ্গে ভাগবাটোয়ারা করে নেন। আবার কারো মতে মতিঝিল প্রাসাদের ভেতরেই কোনো গুপ্ত কক্ষে কিম্বা কোনো গোপন সুড়ঙ্গে বেগম হয়তো ধনরত্ন গুলি লুকিয়ে রেখে যান সিরাজের মতিঝিল আক্রমণের সময়।

আরও পড়ুন
প্রয়াত ফরেস্ট ফেন, রেখে গেলেন গুপ্তধনের অপেক্ষায় থাকা অসংখ্য অনুরাগীকে

ঘাসেটি বেগমের ধনভাণ্ডার নিয়ে এলাকায় আরও একটি মত রয়েছে। যেটি মুর্শিদাবাদে আজও খুব প্রচলিত। তা হল, ঘসেটি বেগম নাকি নবাব সিরাজের আক্রমণের খবর পেয়ে তাঁর সমস্ত ধনসম্পদ একটি ঘরে রেখে তার দরজা, জানালা ইট দিয়ে গেঁথে বন্ধ করে দিয়েছিলেন। ঘসেটি বেগম হয়তো ভেবেছিলেন একদিন তিনি ছাড়া পাবেন এবং এসে তার সমস্ত ধন সম্পদ তিনি উদ্ধার করবেন। কিন্ত ভাগ্য তাঁর সঙ্গ দেয়নি। কথিত রয়েছে যে, পলাশীর যুদ্ধে জেতার পর মীরজাফরের পুত্র মীরন তাঁকে বুড়িগঙ্গার জলে ডুবিয়ে হত্যা করে। 

আরও পড়ুন
৩১০ বছর আগে ডুবে যাওয়া জাহাজ থেকে উদ্ধার কোটি কোটি টাকার ধনসম্পত্তি

আজও মতিঝিলে সেই রহস্যময় ঘরটি রয়ে গেছে। যার অবস্থান মতিঝিল মসজিদ বা কালা মসজিদের ঠিক পাশেই। এই রহস্যময় ঘরটি নিয়ে যুগ যুগ ধরেই সাধারণ মানুষের মনে কৌতূহলের অন্ত নেই। অনুমান করা হয় যে, এই ঘরের ভেতরেই নাকি রয়েছে ঘসেটি বেগমের হারানো সেই গুপ্তধনের ভাণ্ডার। অনেকের মতে সিরাজের আক্রমণের ফলে নয় বরং বর্গীদের হাত থেকে বিপুল ধনসম্পদ রক্ষা করতেই নাকি বেগম এই ঘরটি নির্মাণ করেছিলেন। তবে যে-কারণেই এই রহস্যময় ঘরটি নির্মাণ করা হোক না কেন, এই ঘরটির সঙ্গে ঘসেটি বেগমের হারিয়ে যাওয়া ধনভাণ্ডারের কাহিনি আজও ওতপ্রোত ভাবে জড়িয়ে।    

আরও পড়ুন
কবিতার মধ্যেই লুকিয়ে ছিল সংকেত, অবশেষে উদ্ধার ফরেস্ট ফেনের গুপ্তধন

নবাবি আমলের পর আসে ইংরেজ আমল। বক্সার যুদ্ধ-পরবর্তী পরাধীন নবাবরা ইংরেজদের দান করে দেন মতিঝিল প্রাসাদ সহ সমগ্র মতিঝিল এলাকা। ঘসেটির স্বপ্নের মতিঝিল পরিচিত হয় ‘কোম্পানিবাগ’ নামে। তখন থেকেই আবার নতুন ভাবে শুরু হয় বেগমের হারানো খাজানা খোঁজার অভিযান। বহু ইংরেজ আধিকারিকরাও  বেগমের হারিয়ে যাওয়া ধনভাণ্ডারের খোঁজ শুরু করেন। ধনভাণ্ডারের লোভে একবার কামান দেগে মতিঝিলের রহস্যময় ঘরটি ভাঙার চেষ্টা করা হয়। ঘরটি না ভাঙলেও দেয়ালে কামানের গোলার আঘাতের ক্ষত আজও স্পষ্ট। কিন্ত কামান দাগার পরিণাম হয়েছিল ভয়ঙ্কর। কথিত রয়েছে যে, রহস্যময় ঘর ভাঙার সঙ্গে যুক্ত প্রত্যেক ব্যাক্তিই নাকি মুখে রক্ত উঠে মারা গিয়েছিল। পরবর্তীকালেও বহুবার এই ঘটনার পুনরাবৃত্তি হয়েছে বলে এলাকাবাসীদের দাবি। ফলে আর কেউই এই ঘরের রহস্য ভেদে কোন আগ্রহ দেখায়নি।

রহস্যময় ঘরটিকে নিয়ে আরও একটি রহস্যের উদ্ভব হয়। রহস্যময় ঘরটির নির্মাণকাল আঠারো শতকের প্রায় মাঝামাঝি হলেও, উনিশ শতকের প্রথম দিকে সিতারাম নামক এক প্রখ্যাত শিল্পীর আঁকা মতিঝিলের ছবিতে এই ঘরটির কোনো অস্তিত্ব নেই। তাই স্বাভাবতই প্রশ্ন ওঠে, ঘরটি আদতে কি তখন ছিল না? নাকি চিত্রকর কোনো এক অজানা আতঙ্কে ঘরটি এড়িয়ে গেছেন? ঘসেটির ধনভাণ্ডারের রহস্য অন্ধকারেই ঢাকা পড়ে আছে। আজও যার কোনো সমাধান সূত্র বের করা সম্ভব হয়নি। 

তথ্যসূত্র -
১)PURNA C.H MAJUMDAR, MUSNUD OF MURSHIDABAD(1704-1904),MURSHIDABAD,1905
কৃতজ্ঞতা স্বীকার
মুর্শিদাবাদের মতিঝিল এলাবাসি এবং মুর্শিদাবাদ নিজামত পরিবারের কিছু প্রবীণ সদস্যবৃন্দ

Powered by Froala Editor