৫০ বছরেও যুদ্ধবিধ্বস্ত পৃথিবীর প্রতীক 'নাপাম গার্ল'

আর্তনাদ করতে করতে রাস্তা দিয়ে ছুটছে বেশ কিছু কিশোর-কিশোরী। তাদের সঙ্গে আরও কিছু সৈনিক। আর এই গোটা দলটাকে তাড়া করে আসছে কুয়াশার মতো ঘন কালো মেঘ। তবে এই ছবির মধ্যমণি বছর নয়েকের এক কিশোরী। তার শরীরে কাপড়ের চিহ্নমাত্র নেই। চোখে মুখে আতঙ্ক, যন্ত্রণা এবং বিভ্রান্তির ছাপ। 

১৯৭২ সাল। ৮ জুন। ভিয়েতনামের (Vietnam) ট্রাং ব্যাং গ্রামের ঠিক প্রান্তেই তোলা হয়েছিল এই ছবি। হ্যাঁ, ঠিকই ধরেছেন। এই ছবি ভিয়েতনাম যুদ্ধের। যার পরিচয় হয়ে উঠেছিল ‘দ্য টেরর অফ ওয়ার’। আর ছবির কেন্দ্রীয় কিশোরীটি পরবর্তীতে পরিচয় পায় ‘নাপাম গার্ল’ হিসাবে। যদিও তাঁর আসল পরিচয় ফান থি কিম ফুক। তৎকালীন সময়ে এই ছবিই আগুনের মতো ছড়িয়ে পড়েছিল ওটা বিশ্বে। হয়ে উঠেছিল যুদ্ধ-বিরোধিতার প্রতীক। আর আজ সেই আতঙ্কের পঞ্চাশ বছর পেরিয়ে যুদ্ধবিধ্বস্ত শিশুদের আশ্রয়দাতা হয়ে উঠেছেন ‘নাপাম গার্ল’ (Napalm Girl)।

ভিয়েতনাম যুদ্ধের সময় মার্কিন বাহিনীর বিমানহানায় ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হয়েছিল নাপাম বোমা। সাধারণ বোমার মতো কোনো অঞ্চলিক ধ্বংসযজ্ঞ নয়, বরং গোটা অঞ্চলেই আগুন ছড়িয়ে দেয় এই বিশেষ বোমা। ভিয়েতনামের ট্র্যাং ব্যাং গ্রামেও বিমানহানার সময় এই বোমাই ব্যবহার করেছিল মার্কিন বাহিনী। আর এই নৃশংস হামলার শিকার হয়েছিলেন কিম ফুক। আগুনে ঝলসে গিয়েছিল তাঁর শরীরের ৩৫ শতাংশ অংশ। এমনকি মুহূর্তের মধ্যে পুড়ে ছাই হয়ে গিয়েছিল জামাকাপড়। 

সে-সময়ে এই গ্রামেই হাজির ছিলেন অ্যাসোসিয়েটেড প্রেসের চিত্রসাংবাদিক নিক উট। তিনিই ক্যামেরাবন্দি করেন এই দৃশ্য। পরবর্তীকালে যে ছবির মুকুটে জুড়ে যায় পুলিৎজার পুরস্কারের পালক। তাঁর দৌলতেই প্রাণ বেঁচেছিল ‘নাপাম গার্ল’-এর। তবে খুব সহজ ছিল না সেই লড়াই। সুস্থ হতে সময় লেগেছিল দীর্ঘ ১৪ মাস! ততদিনে পৃথিবীর প্রায় সর্বত্রই ছড়িয়ে পড়েছে তাঁর নগ্ন ছবি। সে-ছবি প্রথম পাতায় ছেপেছে বিশ্বের তাবড় পত্রিকারা। লজ্জা এবং আতঙ্কে গুটিয়ে গিয়েছিলেন কিম ফুক। চিত্রগ্রাহক নিক উটের প্রতি তাঁর ঘৃণাও উদ্রেক করেছিল এই ঘটনা।

এখানেই শেষ নয়। যুদ্ধ শেষ হওয়ার পর, তাঁকে নিয়ে শুরু হয় রাজনীতি। ভিয়েতনামের জাতীয় রাজনৈতিক দলগুলিই প্রচারের হাতিয়ার করে নিয়েছিল তাঁকে। ছাড়তে হয়েছিল স্কুল, কলেজ। অধরা থেকে গিয়েছিল চিকিৎসক হওয়ার স্বপ্ন। তবে হার মানেননি কিম ফুক। পরবর্তীতে কানাডা প্রশাসন অভিবাসী হিসাবে আশ্রয় দেয় তাঁকে। সেখানেই শুরু হয় তাঁর জীবনের দ্বিতীয় অধ্যায়। 

তবে ‘দ্য টেরর অফ ওয়ার’ ছবিটিকে ঘিরে তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি বদলে গিয়েছিল আরেকটু বড়ো হতেই। বুঝতে পেরেছিলেন, তাঁর এই নগ্ন ছবিই আন্দোলিত করে তুলেছিল গোটা পৃথিবীকে। সংবাদমাধ্যমের প্রথম পাতায় প্রকাশিত এই ছবি, বদলে দিয়েছিল যুদ্ধের সম্পর্কে হাজার হাজার মানুষের প্রথাগত চিন্তাভাবনাকে। যার পরোক্ষ ফলাফল, ১৯৭৫-এ ভিয়েতনাম যুদ্ধের অবসান। এই উপলব্ধির পর নিজের অসহায়তাকেই তিনি বদলে ফেলেছিলেন হাতিয়ারে। এই ছবিকে অস্ত্র করে সামিল হয়েছিলেন শান্তির বার্তা প্রচারের পথে। পেয়েছেন একাধিক শান্তির পুরস্কার। ১৯৯৭ সালে হয়ে উঠেছিলেন রাষ্ট্রপুঞ্জের গুডউইল অ্যাম্বাস্যাডার। 

সেইসময় থেকেই তাঁর লড়াই চলে আসছে, যুদ্ধবিধ্বস্ত শিশুদের নিয়ে। বলতে গেলে তাঁদের ত্রাতা হয়ে উঠেছেন ‘নাপাম গার্ল’। আফগানিস্তান যুদ্ধ, সিরিয়া, ইরান— প্রতিটি যুদ্ধের সময়ই তিনি পাশে দাঁড়িয়েছেন নিপীড়িত শিশুদের। কখনও পাঠিয়েছেন ত্রাণ সাহায্য। কখনও আবার তাঁদের অন্যত্র অভিবাসনের বন্দোবস্ত করেছেন স্বয়ং। আশ্চর্যের বিষয়, সেই ভয়াবহ বিমান হামলার ৫০ বছর পেরিয়েও আজও সম্পূর্ণ সুস্থ নন তিনি। প্রতি মাসে নিয়ম করেই তাঁকে হাজিরা দিতে হয় চিকিৎসকের কাছে। চলে নানাবিধ পরীক্ষানিরীক্ষা, থেরাপি। কখনও কখনও অস্ত্রোপচারও। সাম্প্রতিক সময়ে ইউক্রেন যুদ্ধের সময়েও, এইসব প্রতিবন্ধকতাকে হারিয়েও অক্লান্তভাবে কাজ করে চলেছেন ‘নাপাম গার্ল’। চেষ্টা করছেন পৃথিবীর মানচিত্রজুড়ে শান্তির পতাকা ওড়াতে…

Powered by Froala Editor