গত দু'দিন ধরে বাংলার নেটিজেন-দুনিয়া বেজায় সরগরম। একটি বাংলা চ্যানেলের তরফ থেকে 'পাণ্ডব গোয়েন্দা' সিরিজ নিয়ে আসন্ন ধারাবাহিকের ট্রেলার প্রকাশ করা হয়েছে। আর সেই ট্রেলারটিই এই গোলমালের হেতু।
পাণ্ডব গোয়েন্দা সিরিজের সঙ্গে জড়িয়ে আছে বাঙালির বেশ কয়েকটি প্রজন্মের আবেগ, আগ্রহ আর ভালোবাসা। ১৯৮১ সালে, ষষ্ঠীপদ চট্টোপাধ্যায়ের কলমে প্রথম এই খুদে গোয়েন্দাবাহিনীর আত্মপ্রকাশ। হাওড়ার বাসিন্দা পাঁচটি স্কুল-পড়ুয়া ছেলেমেয়ে- বাবলু, বিলু, ভোম্বল, বাচ্চু আর বিচ্চু- এবং তাদের পোষ্য কানা কুকুর পঞ্চু- এদের নিয়েই গড়ে উঠেছে পাণ্ডব গোয়েন্দার দল। রহস্যের খোঁজে, দুষ্কৃতী দমনের নেশায় পাণ্ডব গোয়েন্দারা আস্তে আস্তে নিজেদের অঞ্চল ছেড়ে পাড়ি দিতে আরম্ভ করেছে ভিন রাজ্যে, ভারতের নানা প্রদেশে। প্রথমে ছোটোগল্প, আস্তে আস্তে উপন্যাস গড়ে উঠেছে তাদের নিয়ে, প্রকাশিত হয়েছে তিরিশটিরও বেশি বই। শুকতারা কিংবা আনন্দমেলার পাতায় পাণ্ডব গোয়েন্দাদের কাহিনি পড়ার কৈশোর-রোমাঞ্চ আজও বাঙালি পাঠক-পাঠিকাদের মন থেকে এতটুকুও ফিকে হয়ে যায়নি।
আর ঠিক এই কারণেই, পাণ্ডব গোয়েন্দা নিয়ে ধারাবাহিক শুরু হওয়ার খবর বাংলার নেটিজেন-সমাজে এত বেশি আলোড়ন ফেলেছে। ক্রাইম থ্রিলার জঁরটি এমনিতেই সবচেয়ে জনপ্রিয় সাহিত্য-প্রকরণগুলির মধ্যে একটি। তার সঙ্গে মিশে থাকে শৈশব-কৈশোরের নস্টালজিয়া। তাই, এই সংবেদনশীল ব্যাপার নিয়ে নাড়াচাড়া করতে হয় খুব সাবধানে। এর আগে ফেলুদা, ব্যোমকেশ, কাকাবাবু, মিতিনমাসি- এইসব জনপ্রিয় গোয়েন্দা-চরিত্র নিয়ে বাংলা ইন্ডাস্ট্রিতে অনেক কাজ হয়েছে - ছোটোপর্দা, বড়োপর্দা উভয়ত। আর, সেসবে এতটুকু স্খলন দেখতে পেলেই প্রতিবাদ আর পরিহাসে মুখর হয়েছেন বাংলার নেটিজেন মহলের বাসিন্দারা। পাণ্ডব গোয়েন্দা নিয়েও, ব্যাপারটা সেরকমই।
এই ধারাবাহিক নিয়ে লেখকের নিজের আগ্রহ কতটা ছিল? শুনলে হয়তো আশ্চর্য লাগবে, বিশেষ ছিল না! প্রহরকে পাণ্ডব গোয়েন্দার স্রষ্টা ষষ্ঠীপদ চট্টোপাধ্যায় স্পষ্ট জানিয়েছেন, "আমি কোনওদিনও সিনেমা বা টিভি সিরিয়ালের ব্যাপারে আগ্রহী ছিলাম না। তবে কেউ এসে বললে আমি না করি না।"
আরও পড়ুন
নবম শতকের চিকিৎসাবিজ্ঞান, ‘মেডিক্যাল এনসাইক্লোপিডিয়া’ ও এক মুসলিম চিকিৎসক-গবেষকের গল্প
আসন্ন ধারাবাহিকটিতে, বাবলুর ভূমিকায় অভিনয় করছেন রব দে। এর আগে তাঁকে আমরা একই চ্যানেলে দেখেছি নেতাজির ভাইপো শিশিরকুমার বসুর ভূমিকায়। এছাড়া বিলুর ভূমিকায় আছেন ঋষভ চক্রবর্তী, ভোম্বলের চরিত্র করছেন ময়ূখ চ্যাটার্জি। বাচ্চু-বিচ্চুর ভূমিকায় যথাক্রমে অনুমিতা দত্ত ও শ্রীতমা মিত্র। এঁরা সকলেই আনকোরা নতুন মুখ। তাঁদের অভিনয় কেমন হবে, তা তো সময়ই বলবে। তবে, শোরগোল যেটা নিয়ে শুরু হয়েছে, তা হচ্ছে ট্রেলারে বাবলু আর বাচ্চুর মধ্যে চোখে চোখে প্রেমজ ইঙ্গিত, এবং তার পটভূমিকায় একেবারে হালফিলের বাংলা গান "প্রাণ দিতে চাই, মন দিতে চাই..."। এই ব্যাপারটি নিয়েই সবচেয়ে বেশি বিতর্ক দানা বেঁধেছে। কেউ কেউ বলছেন, এ একেবারে বিশ্রী ব্যাপার ঘটলো! আবার কেউ কেউ মনে করিয়ে দিচ্ছেন, স্বয়ং লেখকই কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এই পাঁচ চরিত্রকে কৈশোর থেকে যৌবনে উপনীত করেছেন। পরের দিকের অভিযানে বাবলুর সঙ্গে প্রায়ই বিভিন্ন তরুণীর ঘনিষ্ঠ বন্ধুত্ব দেখা গেছে, এমনকি বাবলুর প্রতি নারীচরিত্রদের প্রণয়ঘটিত আকর্ষণ ও রেষারেষির কথাও লেখক ইতোমধ্যে একটি উপন্যাসে লিখেছেন। তাই, বাবলু ও বিচ্চুর মধ্যে যদি যৌবনের স্বাভাবিক নিয়মে কোনও প্রেমজ ঘনিষ্ঠতা গড়ে ওঠে, তা নিয়ে নাক সিঁটকোবার বা হাহাকার করবার খুব একটা যৌক্তিকতা আছে কি?
স্বয়ং ষষ্ঠীপদ চট্টোপাধ্যায় কী ভাবছেন এই নিয়ে? প্রহরের প্রশ্নের উত্তরে তিনি জানিয়েছেন, "যেটা আমার একটু খারাপ লাগছে- পাণ্ডব গোয়েন্দারা যখন অ্যাডাল্ট হয়েছে, একটু বড়ো হয়ে গেছে, আমার আনন্দমেলায় যে উপন্যাস-টুপন্যাসগুলো বেরিয়েছিল- তখন দেখা যাচ্ছে যে, বেড়াতে চলে গেল, হঠাৎ ট্রেনে কারোর সঙ্গে পরিচয় হয়ে গেল, সে বলল আমাদের ওখানে চলুন- সেখান গিয়ে হয়তো...। কিশোর বয়স তো, একটা রোমান্স হয়তো দেখানো যায়!
আরও পড়ুন
অশুভ ‘বস্তু’, অভিশাপ ও তন্ত্র বারেবারেই এসেছিল বিভূতিভূষণের গল্পে
কিন্তু, পাণ্ডব গোয়েন্দাদের টিম যখন থেকে তৈরি হয়েছে তখন থেকে তারা তো ভাই-বোনের মতো! তাদের মধ্যে তো রোমান্স দেখানো যায় না! এরা তো তাই করছে!"
দর্শক মহলের মনঃপীড়ার আর কোনও কারণ কি নেই? আছে, অবশ্যই আছে। অনেকেই বলছেন, এই ট্রেলারে পাণ্ডব গোয়েন্দাদের পোষ্য পঞ্চুর ছোটাছুটি, গাড়িতে আকস্মিক বোমা বিস্ফোরণ ইত্যাদি দৃশ্যগুলি অ্যানিমেশনের মাধ্যমে নির্মাণ করা হয়েছে, এই ক্ষেত্রে বেশ আরো অনেকখানি যত্নশীল হওয়ার দরকার ছিল। ঝাঁ-চকচকে আধুনিক পোশাক পরা হালফিলের ছেলেমেয়েরা কেন যে গান শোনার জন্য রেডিও বা টেপ-রেকর্ডার (গানটিও ২০১৯ সালে মুক্তি পাওয়া 'পরিণীতা' ছায়াছবির গান) ব্যবহার করবে, সেটা বোঝা গেল না। আবার কেউ প্রশ্ন তুলছেন, আচ্ছা, বিচ্চু বাইনোকুলার চোখে লাগিয়ে এত কিছু খেয়াল করল, আর গাড়ির নাম্বারের দিকে নজর দিল না, এ কেমন কথা? আর, তরুণ তুর্কী গোয়েন্দা বাহিনীর মধ্যে একটি প্রেমজ সম্পর্ক দেখানো আধুনিক দৃষ্টিতে হয়তো খুব দোষাবহ নয়, কিন্তু অন্যান্য ধারাবাহিকের মতো এই নিয়ে অতিরিক্ত ঘোঁট না পাকলেই, আমরা পাণ্ডব-গোয়েন্দা প্রেমীরা খুশি হবো, এই আরকি। বিদগ্ধ দর্শকেরা স্বীকার করেছেন, সাহিত্য থেকে সিরিয়াল- মাধ্যম-পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে প্লট, চরিত্র, পরিবেশ সবই বদলাবে, বদলাতে বাধ্য। কিন্তু সেই বদল যদি বড্ডো বেশি চোখে লাগে, সেটা ভালো কথা নয়।
আরও পড়ুন
বাংলার ভূতের গল্পে ননসেন্স ছড়াও জাঁকিয়ে বসেছিল দিব্যি
তবে, অনেকের কাছেই সবচেয়ে বেশি আপত্তির জায়গাটা হচ্ছে, ট্রেলার অনুযায়ী এই ধারাবাহিকে কেবল পাণ্ডব গোয়েন্দাদের যৌবনবেলার কাহিনিই দেখানোর পরিকল্পনা রয়েছে মনে হচ্ছে। তাহলে, বাঙালির ছোটোবেলার সেই স্কুল-পড়ুয়া কিশোর-কিশোরীদের প্রিয় অভিযানগুলি একেবারেই বাদ পড়বে, প্রথম থেকেই দেখতে হবে এক ধাক্কায় বড়ো হয়ে ওঠা পাণ্ডব গোয়েন্দাদের অ্যাডভেঞ্চার। এটা একটা বড়োসড়ো মন খারাপের জায়গা তো বটেই, কারণ এমনটা হলে আমাদের শৈশবস্মৃতির একটা বিরাট বড়ো অংশ এই ধারাবাহিক থেকে বাদ পড়ে যাবে। নতুন প্রজন্মের দর্শক, যারা বইতে অনাগ্রহী, তাদের কাছে যদি পাণ্ডব গোয়েন্দা সিরিজের এরকম একটি খণ্ডিত উপস্থাপন পৌঁছোয়, সে বড়ো দুঃখের কথা হবে। আহত হবে বাঙালির নস্টালজিয়া।
প্রহরের কাছে এ-নিয়ে দুঃখ প্রকাশ করে বলেছেন স্বয়ং ষষ্ঠীপদ- "আমার বই, আমার লেখা যদি খারাপ হয়, মানুষ গালাগালি দেবে, আমি বই লেখা বন্ধ করে দেব। এখন টিভির ভেতর যেটা হচ্ছে, সেটাকে তো আমি বন্ধ করতে পারব না। এটা কোনও বিত্তবান ক্ষমতাবান মানুষ রুখে দাঁড়িয়ে যদি বন্ধ করে দেয়,... সেটা আলাদা ব্যাপার। কিন্তু আমি তো ওখানে হাত দিতে পারব না। কেননা সইও আমিই করেছি, অনুমতিও দিয়েছিলাম আমিই।" চূড়ান্ত হতাশা থেকে লেখকের বিস্ফোরক মন্তব্য, "আমার লেখক জীবনের দুর্ভাগ্য, যে আমাকে মরবার বয়সে এইটে দেখে যেতে হল।"
তবে, এখন থেকেই নৈরাশ্য পোষণ করা ঠিক নয়। যে চ্যানেলটি এই ধারাবাহিক আনতে চলেছে, গতানুগতিক গার্হস্থ্য কোন্দল থেকে বেরিয়ে এসে একটু অন্য স্বাদের সিরিয়াল বানানোর চেষ্টা তাঁদের অনেকদিনের। বিখ্যাত বাংলা উপন্যাস থেকে প্রাক্-স্বাধীনতা যুগের বাঙালি মেয়েদের জীবনযন্ত্রণা, দেশভাগ ও গণ-পরিযানের বিষাদ ইত্যাদি তাঁরা এর আগে ছোটোপর্দায় এনেছেন। কলকাতার দাপুটে ধর্মনেতা ও সমাজ-সংস্কারক, সকলের বন্দনীয় স্বাধীনতা-সংগ্রামী কিংবা নারীশিক্ষার অগ্রদূতদের নিয়ে ইতিহাস-নির্ভর ধারাবাহিক পরিবেশনের কৃতিত্বও তাঁদের ঝুলিতে আছে। তবে সব ক্ষেত্রেই দেখা দিয়েছে মিশ্র প্রতিক্রিয়া। আমজনতা এইসব ধারাবাহিকের প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয়েছেন, হু হু করে বেড়েছে চ্যানেলের টি আর পি। সেইসঙ্গে, বুদ্ধিজীবী সমাজ ইতিহাসের তথ্যবিকৃতি নিয়ে মাঝে-মধ্যেই সরব হয়েছেন।
এখন দেখা যাক, এই নতুন ধারাবাহিক বাঙালির আশা কতখানি পূরণ করতে পারে। সে কথা সময়ই বলবে।
Powered by Froala Editor