তিনটে জোয়ান ছেলেকে এক আঙুলের টোকায় ফেলে দিয়েছিল মেয়েটা

হরেমামাকে বললাম – “তোমার সেদিনের ভূতের গল্পটা বেশ ছিল কিন্তু।” 

অন্য একজনের সঙ্গে গল্পে মশগুল থাকায় মামা সহজে ধরতে পারে না আমার কথা। জিজ্ঞাসা করে – “কোন ভূতের গল্প, বলো তো?”

আমি ধরিয়ে দিই – “সেদিন যেটা বললে। সেই ঊষার স্কুলের ওখানে সাদা শাড়ি পরা কাকে একটা দেখেছিলে।”

তখন সে খুশি হয়ে বলে ওঠে – “হেঁঃ হেঁঃ। বাবা রে, সে এক দেখেছিলাম।”

আরও পড়ুন
‘ঊষার স্কুলের বারান্দায় ডাব খাচ্ছি, রাত তখন দেড়টা’

তারপর আগের দিনের মতোই সঙ্গে যোগ করে – “লোকে বলেছিল, আমি ভয় পাইনি বলে আমায় কিছু করার সাহস পায়নি। ভূত দেখে যারাই ভয় পায়, ভূত তাদেরই হালত খারাপ করে দেয়।”

আরও পড়ুন
‘পঞ্চপাণ্ডবের রথের চাকার দাগ দেখছি, তেড়ে এল ভালুক’

কথাটা শুনে মামার দিকে তাকিয়ে মুখ টিপে হাসি। সে কী ভাবল কে জানে! আমি যে কেবল গল্পই উপভোগ করেছি, সত্য ঘটনা হিসেবে তাকে যে কোনও মর্যাদাই দিইনি, সে খবর মামা জানে না। 

বলে রাখা ভালো, ভূত, হানাবাড়ি, পৃথিবীতে ঘটে যাওয়া নানা অদ্ভুত ঘটনা, কাকতাল এসব বিষয়ে আমার আকৈশোর এক অদম্য কৌতূহল ছিল, এখনও আছে। তফাতের মধ্যে, তখনকার অনভিজ্ঞ মনের ওপর ভয়ের সঙ্গে যাচাই-বিহীন বিশ্বাসও চেপে বসত, এখন বেশ বেপরোয়াভাবেই এসব ঘটনাকে উড়িয়ে দেওয়ার সহজাত ক্ষমতা রাখি আমি। আদৌ পরলোক বলে যদি কিছু থেকে থাকে, আর আপাতত ইহলোক-পরলোকের মাঝামাঝি নোম্যানস ল্যান্ডে থাকা কিছু বাসিন্দা যদি এই মুহূর্তে বিধানপল্লীর বিবেকানন্দ ব্যায়ামাগারের আশেপাশের বায়ুমণ্ডলে ঘুরঘুর করেন, তাঁরা এই ভাবনা শুনলে মনঃক্ষুণ্ণ হবেন ঠিকই। চাই কি মামার দেখা সেই সাদা কাপড়-পরিহিতা ছায়া-বুড়ির মতো আমার অনিষ্ট করার কথাও ভাবতে পারেন।

কিন্তু এই মুহূর্তে হরেমামাকে সেসব বলার কোনও অর্থ হয় না। তারা যে বিধানপল্লী দেখে বড়ো হয়েছিল, সেই জংলা, নির্জন এলাকায় এই ধরনের অলৌকিকতা-বিশ্বাসী মানসিক অবস্থা স্বাভাবিক উপায়েই তৈরি হয়। সেখানে অপদেবতা, দেবতা, দুইই সমান বিশ্বাস ও ভয়ের নৈবেদ্য পেয়ে থাকেন। আমি বরং কৌতূহল নিয়ে জিজ্ঞাসা করি – “আর কখনও এমন কিছু দেখেছিলে?”

হরেমামা তখন হতাশ হয়ে বলে – “নাহ, আর কখনও ভূতের দেখা পাইনি।” 

তারপর, তার স্বভাবমতো কিছুক্ষণ থেমে যোগ করে – “তবে আমার বন্ধুদের সঙ্গে একবার একটা ঘটনা ঘটেছিল। একটা মেয়ের পাল্লায় পড়েছিল। সেটা তাহলে তোমায় বলি।”

ভূতের সঙ্গে মেয়ের কী সম্পর্ক, আমি বুঝলাম না। বললাম – “মেয়ে মানে? হচ্ছিল তো ভূতের কথা!”

মামা তখন মুচকি হেসে বলে – “যে-সে মেয়ে নয় তো। আমার তিন বন্ধুকে আঙুলের একটা টোকা দিয়ে মাটিতে ফেলে দিয়েছিল।”

চূড়ান্ত অবিশ্বাসের সঙ্গে বলে উঠি – “কী আজেবাজে বকছ?”

-বুঝতে পারলে না? ওটা মেয়ে নয়, পেত্নী ছিল।

এবার আমার চমকানোর পালা। পেত্নী! অবিবাহিত মেয়েরা অপূর্ণ আশা নিয়ে অপঘাতে মরে গেলে পেত্নী হয় – এই মতই প্রচলিত দুই বাংলায়। ‘প্রেতিনী’ থেকে চলতি ভাষায় ‘পেত্নী’। তেঁতুল বা শ্যাওড়া গাছে বসে সে পা দোলায়, জীবন্ত মানুষের রূপ ধারণ করতেও সে নাকি অত্যন্ত পটু। অবিবাহিত যুবক দেখলেই তাদের ভুলিয়ে নিয়ে যাওয়ার ব্যাপারে তার বড়ো বদনাম। 

অথচ, অত্যন্ত সামান্য ইচ্ছা পূরণ হল না যে সাধারণ গ্রাম্য মেয়েটির, অকালে ঝরে যাওয়া সেই প্রাণটির কথা ভেবে বোধহয় আমাদের সমব্যথী হওয়ার প্রয়োজন ছিল।

শুধু পেত্নীর কপালেই এই দুর্নাম জোটেনি। পৃথিবীর ভূত সংস্কৃতির সার কথা হল, সকল ভূতই অপকৃষ্টকারী। এই যে লৌকিক বাস্তবতার বাইরেকার কোনও অজানা অস্তিত্বকে নিয়ে মানুষের মনে অহেতুক ভয়ের নির্মাণ, এসব দেখে কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের মতো করে লিখতে ইচ্ছে জাগে – “ভূতকে দিয়ে মানুষ বড়ো বেশি অনিষ্ট করায়।” অবশ্য এই বায়ুদেহধারীদের মধ্যে সকলেই খারাপ হন না, উপকারীও কেউ-কেউ থাকেন। অপঘাতে মৃত কোনও শুভাকাঙ্খীর আত্মা অনেক সময়ে জীবনের কঠিন মুহূর্তে আবির্ভূত হয়ে বাঁচবার উপায় বলে দিচ্ছে, এসব হামেশাই ঘটেছে। সে যুদ্ধের ময়দানেই হোক, বা পাহাড় চড়ার সময়ে। 

বাংলার ভূত সংস্কৃতিও ব্যতিক্রম কিছু নয়। এখানে অনিষ্টকারী প্রেত, প্রেতিনি, শাঁকচুন্নী, মেছোভূত, গেছোভূত, কানাভুলো, একানড়ে, হাঁকামনা, দুধচোরা, পেঁচাপেঁচি, বেঘোভূত, নিশি, বেঁশোভূত, দেও, মামদো, আলেয়া, জ্বিন, জ্বিন-পরী, খবিস, ইবলিশ এরা একদিকে, আর স্বনামখ্যাত ব্রহ্মদৈত্য মশাই একদিকে। তিনি বেলগাছে বসবাস করেন, তাঁর গলা থেকে পৈতে ঝোলে, গ্রামের অন্ধকার রাস্তায় অন্যান্য ভূতপ্রেতদের উপদ্রব থেকে বাঁচতে একলা পথিকের কাছে তিনি পরম ভরসার জায়গা। ব্রাহ্মণ মানুষ, থুড়ি ভূত, তাই অন্যান্য প্রেতাত্মারাও তাঁকে বেশ মান্যিগন্যি করে। তবে হ্যাঁ, রাতের অন্ধকারে গ্রামের রাস্তায় যেতে যেতে অনেকেই বেলগাছে ছোটো কাজ সেরে ফেলেন, এই বিষয়টি তাঁর আবার ভারী অপছন্দের। একমাত্র এই অশুচি কাজটি করলেই তিনি ভয়ানক কুপিত হয়ে ওঠেন। তখন আবার ভয়ালদর্শন রূপ ধারণ-টারণ করে নেন, কখনও ঘাড়ও মটকে দেন এমন শোনা যায়। তা বাদ দিলে, তিনি বেজায় ‘কুল’। 

তবে কিনা ওই পৈতের দরুণই যে সর্দার এবং উপকারী হওয়ার একমাত্র লাইসেন্সটা তাঁকেই দিয়েছেন বঙ্গ-ইহলোকের তত্ত্বজ্ঞানীরা, এ বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই। সব মিলিয়ে বেশ একটা ব্রাহ্মণ্যবাদী ব্যাপারস্যাপার।

হরেমামাকে জিজ্ঞাসা করলাম – “তা তোমার বন্ধুরা পেত্নীর পাল্লায় পড়লই বা কীভাবে?”

তখন সে শুরু করে – “বিধানপল্লীতে তখন খুব ফাংশন হত। রাতের বেলায়। আমরা যেতাম। একবার গেছি, গিয়ে দেখি একটা মেয়ে। খুব সুন্দর দেখতে। লালপাড় সাদা শাড়ি পরে আছে, কপালে এত বড়ো সিঁদুরের টিপ। আমার এক বন্ধু ছিল, সে আবার মেয়েলি ব্যাপারে খুব ওস্তাদ। রাস্তায় মেয়ে গেলেই গিয়ে কথা বলত। ওই মেয়েটাকে দেখেই তার শখ চেপেছে। তাকে গিয়ে বলেছে, সে নাকি রাজিও হয়েছে।”

কীসের শখ, আন্দাজ করছিলাম কিছুটা। তবু চুপ করে থাকি। হরেমামা বলতে থাকে – “ফাংশনের পরে তিনজন বন্ধু মিলে তাকে নিয়ে গেছে ঊষার মাঠে। কেন নিয়ে গেছে, বুঝতেই পারছ। নোংরামো করবে মেয়েটার সাথে। তারপরে শুনেছি, তিনজনে যতবার তার দিকে এগোয়, সে একটা আঙুল দিয়ে টোকা মেরে তিনজনকে ফেলে দেয়। এরকম বেশ কয়েকবার হয়েছে।”

দৃশ্যটা কল্পনা করতে খানিক কষ্ট হয়। ভ্রূ কুঁচকে প্রশ্ন করি – “আচ্ছা! তারপর?”

তারপর ওদের মধ্যে একজন বলেছে, দাঁড়া তো, এভাবে হবে না। ওদিকে ধোবিখানা ছিল। সেখানে গিয়ে ওই বন্ধুটা গিয়ে নারকেল ছোবড়ার দড়ি এনেছে। সেই দড়ি দিয়ে মেয়েটাকে তিনজনে মিলে গাছের সঙ্গে বেঁধেছে। কুড়ি-পঁচিশটা ফাঁস দিয়েছে। তারপরে আবার যেই এগোতে গেছে, সে আবার তিনজনকে ফেলে দিয়েছে, তারপর দু’হাত দিয়ে খানিক ঝাঁকুনি দিতেই দড়ি খুলে গেছে। অত শক্ত করে কুড়ি-পঁচিশটা ফাঁস দিয়ে বেঁধেছিল, কিছুই হয়নি তাতে।

-তারপর কী হল?

হরেমামা হাসতে হাসতে বলল – “আর ওরা কি ওখানে থাকে? ভয়ে দৌড় দিয়ে পালিয়ে এসেছে সব। সকলকে যখন বলল, সকলেই বলল, ওটা পেত্নীই ছিল। নয়তো ওদের ইয়া ইয়া চেহারা, তাদেরকে অমন এক আঙুল দিয়ে ফেলে দিচ্ছে! তারপর অত শক্ত করে বেঁধেছে, সেই গিঁট এরকম হাত দিয়ে ঝেড়ে খুলে দিয়েছে! পেত্নী ছাড়া আর কী?”

এবার আমি জিজ্ঞাসা করলাম – “ওরা ধোবিখানা থেকে দড়ি আনল, তারপর ওকে বাঁধল, তা ওর চোখের সামনেই এত কাণ্ড যখন ওরা করছে, তখন সে কিছু বাধা দেয়নি বা বলেনি?”

হরেমামা প্রশ্নটা বুঝে নিয়ে বলল – “না, সে তখন রগড় দেখছিল, কিচ্ছু বলেনি। পরে যা খেল দেখাল, ওরা তিনজনেই বুঝল, কার পাল্লায় পড়েছে।”

আরেকটা প্রশ্নও মাথায় ঘুরছিল, সেটাও বললাম – “আচ্ছা, পেত্নীদের তো পা উল্টোদিকে বাঁকানো থাকে বলে শুনেছি। সেটা দেখেই নাকি চেনা যায় ওদের। ওই মেয়েটার সেরকম কিছু ছিল না?”

মামা এই প্রশ্নটা আশা করেনি। সামাল দেওয়ার জন্য বলল – “আমি তো আর ওখানে ছিলাম না, ভাগ্নে। থাকলে সবটা দেখতে পেতাম। এটা পুরোটাই ওদের কাছ থেকে শোনা কথা।”

হরেমামা অকুস্থলে উপস্থিত ছিল না, থাকলে হয়তো আরও অনেক কিছুই বলতে পারত সে। মেয়েটির পায়ের পাতা উল্টোদিকে বাঁকানো ছিল না, তার লাল চোখ বা হিংস্র শ্বদন্ত ছিল কিনা, বীরপুঙ্গব-ত্রয়ী ছুটে পালানোর সময়ে সে খোনা সুরে ‘হিঁঃ-হিঁঃ-হিঁঃ’ করে বিজয়িনীর হাসি হাসছিল কিনা, ইত্যাদি ইত্যাদি।

অলংকরণ - অমর্ত্য খামরুই

Powered by Froala Editor

More From Author See More

Latest News See More