নদীতে ভাসছে গুলিবিদ্ধ বাবার দেহ; পাক সেনার নির্যাতনের শিকার হুমায়ূন আহমেদও

১৯৭১ সাল। ওপার বাংলার মানুষেরা বেঁচে আছেন আগুনের মধ্যে। ইংরেজদের কাছ থেকে মুক্তি মিললেও স্বাধীনতা কোথায়? পশ্চিম পাকিস্তানের সেনা, হানাদারদের বেয়নেট আর গুলির মুখেই দিন কাটছে তাঁদের। একসময় প্রতিবাদের ঢেউ উঠল পূর্ব পাকিস্তান জুড়ে। এদিকে সেনারাও একের পর এক মানুষদের আটক করছে, হত্যা করছে। এমন সময় তাঁদের হাতে বন্দি হলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক তরুণ ছাত্র। নাম, হুমায়ূন আহমেদ। চশমা পরিহিত, শ্যামলা ছেলেটির প্রতি ঘোর সন্দেহ সেনাদের। এঁর বাবাও মুক্তিযোদ্ধাদের সাহায্য করতে গিয়েছিলেন; পরিণতিও মিলেছে হাতেনাতে। এবার ছেলেটির পালা। দীর্ঘদিন ধরে চলল অত্যাচার। একসময় তরুণটির ভগ্ন শরীর লক্ষ্য করে চলল গুলি…

সব শেষ হয়ে যেতে পারত; হল না। ছেলেটি বেঁচে গেল অদ্ভুতভাবে। প্রাণে বাঁচেননি তাঁর বাবা। ফয়জুর রহমান আহমেদের তখন পুলিশের চাকরি। পিরোজপুরে পোস্টিং। ’৭১-এর ২৫ মার্চ বাংলাদেশে স্বাধীনতা ঘোষণা হয়। আর তার ঠিক দুদিন পর, ২৭ তারিখ পুলিশ ফাঁড়ি থেকে ২০০টি রাইফেল তুলে দেন সাধারণ মানুষের হাতে, মুক্তিযুদ্ধে লড়ার জন্য। এর কয়েকমাস পর, পাকিস্তানি সেনা পিরোজপুরে পৌঁছে হত্যা করে ফয়জুর রহমান আহমেদকে। বলেশ্বর নদীতে ভাসতে থাকে রক্তাক্ত ও গুলিবিদ্ধ দেহ। বাবার এই পরিণতি হুমায়ূনকে তাড়া করে বেরিয়েছে আজীবন। লেখাতেও তাই ফিরে-ফিরে এসেছে মুক্তিযুদ্ধের প্রসঙ্গ।  

মনে পড়ে হুমায়ূনের ছোটোবেলার একটি গল্পের কথা। ততদিনে তাঁর হাতে এসে গেছে ‘ক্ষীরের পুতুল’। বাংলা সাহিত্যের সঙ্গে পরিচিতি শুরু হয়েছে একটু একটু করে। বাবা-মা আর ভাই বোনের সঙ্গে গেছেন দিনাজপুরের এক জমিদার বাড়ি। সেখানেই ছোট্ট হুমায়ূনের সঙ্গে ভাব হয়ে যায় একটি কুকুরের। ওই বাড়িরই পরিত্যক্ত সে। হঠাৎ একদিন কেউটে সাপের ছোবলে নিস্তেজ হয়ে গেল কুকুরটি। চোখের সামনে সেই মৃত্যু দেখলেন হুমায়ূন। মৃত্যু! জীবনে দুটি জিনিসকে একদম কাছ থেকে দেখতে চেয়েছিলেন— জন্ম আর মৃত্যু। ভেতরে ভেতরে কি হিমুও বেড়ে উঠছিল? 

একবার এক ডাক্তার বন্ধুর কাছে গিয়ে রীতিমতো অনুনয়ের সুরে বললেন, যদি কোনো রোগী মৃত্যুশয্যায় থাকে, তাহলে তাঁকে যেন একবার ডাকা হয়। এমন শখ কেন? কারণ তিনি সামনে থেকে দেখতে চান মৃত্যুকে। সেই অনন্ত সম্ভাবনার সামনে পড়ে মানুষের রূপ কেমন করে বদলে যায়, সেটাই দেখবেন তিনি। সেইমতো একবার তাঁকে খবরও দেওয়া হল। রোগীর প্রায় শেষ অবস্থা। ডাক্তাররা আশা ছেড়েই দিয়েছেন। অদ্ভুত ব্যাপার, হুমায়ূন আহমেদ আসার খানিক পরেই ওই বৃদ্ধ রোগীর হাত ছেড়ে বিদায় নিল মৃত্যু। সুস্থ হয়ে উঠলেন তিনি। এ কেমন পরিহাস! ভাগ্য যে আরও বড়ো মঞ্চ তৈরি করে রেখেছে হুমায়ূনের জন্য। চোখের সামনে মারা গেল তাঁর ছোট্ট ছেলে। মৃত্যুকে চাক্ষুষ করলেন নিজের স্পন্দনহীন ছেলের দেহ ধরে… 

বিদেশের দার্শনিকরা বলেন, পৃথিবীর ইতিহাস নাকি তৈরি করেছে পাগলরা। হুমায়ূন আহমেদ কি সেই পাগলদেরই এক শরিক ছিলেন? সবেমাত্র বিশ্ববিদ্যালয়ে রসায়নের অধ্যাপক হিসেবে ঢুকেছেন। বেতন খুব বেশি নয়। যে সরকারি বাড়িতে থাকেন, তাঁর ভাড়াও দেওয়া হয়নি বহুকাল। পুলিশ এসে নোটিশ ধরিয়ে গেছে। এমন অবস্থায় সিদ্ধান্ত নিলেন, বিয়ে করবেন। পাত্রী কিশোরী গুলতেকিন খান। সমস্ত বাধা-বিপত্তি পেরিয়ে বিয়ে করলেনও; আর তারপরেই মাথার ওপর থেকে সরে গেল ছাদ। সরকারি আবাসন থেকে সপরিবারে বেরিয়ে যেতে বাধ্য হলেন হুমায়ূন আহমেদ। তখন কে আর জানত, পরবর্তীকালে স্রেফ লিখে, ছবি পরিচালনা করে সেন্ট মার্টিন দ্বীপে একটি বাড়ি কিনে ফেলবেন! 

অধ্যাপনার চাকরি ছেড়ে স্রেফ লেখালেখিকেই জীবন হিসেবে বাছলেন হুমায়ূন। সৃষ্টি হল একের পর এক গল্প, উপন্যাস। জন্ম হল ‘হিমু’, ‘মিসির আলি’র। দুই বাংলার বহু কিশোর-তরুণ আজও হিমু হতে চায়। পকেটহীন হলুদ পাঞ্জাবী পরে, এক অদ্ভুত ছেলে রাতের শহর দেখছে। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘নীললোহিত’ যেমন কলকাতায়, তেমনই ঢাকার রাস্তায় হুমায়ূনের ‘হিমু’। ওপারে জনপ্রিয়তা তুঙ্গে। একুশে বইমেলায় পৌঁছে সমরেশ মজুমদার দেখেছেন, স্রেফ হুমায়ূন আহমেদের বইয়ে একটা সই পাওয়ার জন্য মানুষের লম্বা লাইন। একদিন নয়, বহুদিন। কয়েক লক্ষ কপি মুহূর্তে বিক্রি হয়ে যায় তাঁর। বাংলাদেশে তখন হুমায়ূন আহমেদ মানেই জীবন্ত কিংবদন্তি। প্রকাশকরা তাঁর নাগাল পাওয়ার জন্য হত্যে দিয়ে পড়ে থাকে। কিন্তু এপার বাংলায়? নব্বইয়ের দশকেও হুমায়ূন আহমেদের নাম শোনেনি পশ্চিমবঙ্গের পাঠক। তাঁর গুটিকতক বই কেবল পাওয়া যায় এখানে। হিমু নিয়ে কোনো আবহাওয়াই তৈরি হয়নি কলকাতায়। অনেকসময় এই নিয়ে দুঃখপ্রকাশও করেছিলেন স্বয়ং স্রষ্টা। এক বাংলা এত কাছে টেনে নিল; আরেক বাংলা কেন এমন নিঃস্পৃহ? 

আরও পড়ুন
একটিবার দেখতে আসুন 'গুরু' শীর্ষেন্দু, চেয়েছিলেন মৃত্যুপথযাত্রী হুমায়ূন আহমেদ

প্রথম উপন্যাস ‘নন্দিত নরকে’ যখন প্রকাশিত হয়, তখন কোনোভাবে বইটি সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় ও ‘দেশ’ পত্রিকার তৎকালীন সম্পাদক সাগরময় ঘোষের হাতে আসে। আর তারই রিভিউ করলেন সুনীল! তরুণ হুমায়ূনের চোখে ভরে উঠেছিল স্বপ্ন। তাহলে ‘দেশ’-এও তাঁর বইয়ের রিভিউ বেরোল! কিন্তু লেখা? তার জন্য অনেকটা অপেক্ষা করতে হয় হুমায়ূনকে। নব্বইয়ের দশক। কলকাতায় এসেছেন হুমায়ূন আহমেদ। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, সাগরময় ঘোষের সঙ্গে একদিন আড্ডাও জমে উঠেছে। সেই সুযোগে মনের ইচ্ছেটা প্রকাশ করেই ফেললেন তিনি। ‘দেশ’-এ কি লেখার সুযোগ পাওয়া যাবে? পরবর্তীকালে সেই নব্বইয়ের দশকেই পত্রিকার শারদীয়া সংখ্যায় আত্মপ্রকাশ তাঁর। তারপর সেই পাতায় জায়গা পেয়েছে ‘হিমু’ও। একটু একটু করে পশ্চিমবঙ্গের পাঠকেরা পরিচিত হলেন এক বিস্ময় লেখনীর সঙ্গে। 

কেবল লেখার মধ্যেই আটকে রাখেননি নিজেকে। নেমে পড়েছিলেন লাইট-ক্যামেরা-অ্যাকশনের জগতেও। নাটক থেকে শুরু করে সিনেমা, টেলিভিশন— সব জায়গায় তুলে ধরেছেন গল্পের সম্ভার। মনে পড়ে ‘বহুব্রীহি’ ধারাবাহিক নাটকের কথা। যখন এটি মুক্তি পায়, তখন বাংলাদেশের গদিতে ছিল এরশাদ সরকার। ‘পাকিস্তানি হানাদার’, ‘রাজাকার’ এই শব্দগুলি একসময় জড়িয়ে ছিল মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে। এরশাদের সময় সেসব নিষিদ্ধ হয়ে গেল। কেউ সাহস করেও শব্দগুলি ব্যবহার করতে পারত না। আর সেখানেই অনন্য হুমায়ূন আহমেদ। ‘বহুব্রীহি’ নাটকেই উচ্চারিত হল ‘তুই রাজাকার’। বহু বছর পর বাংলাদেশ সাক্ষী থাকল এমন মুহূর্তের। তাও কে বলল? কোনো অভিনেতা নন, একটি টিয়াপাখি। মানুষ বললে তাঁর জীবনহানি হতে পারে, চিহ্নিতও করে ফেলা যাবে। কিন্তু টিয়াপাখি বললে? শেষমেশ গোটা বাংলাদেশে শ্লোগানে পরিণত হয়ে গিয়েছিল ‘তুই রাজাকার’… 

সবই চলছিল। যেমন করে রাতের ফুটপাত ধরে ঘুরে বেড়ায় হিমুরা। কিন্তু সেখানে যোগ দিতে পারলেন না হুমায়ূন আহমেদ। নিজের ভেতর মৃত্যুর আওয়াজ যেন শুনতে পাচ্ছিলেন। গুলতেকিনের সঙ্গে বিচ্ছেদ হওয়ার পর বিয়ে করেছিলেন মেহের আফরোজ শাওন-কে। বয়সে অনেকটাই ছোটো; কিন্তু আত্মার মিলন কি আর বয়স দেখে হয়? এমন সময় হানা দিল ক্যানসার। হাসিমুখে দৈত্যকে মেনে নিলেন হুমায়ূন। এবার হিমুর কাছে যাওয়ার সময়। তবে যাওয়ার আগে, রূপাকে একবার টেলিফোন করে নিলে হয় না!… 

আরও পড়ুন
ইন্দিরা গান্ধীর জরুরি অবস্থার প্রতিবাদে পত্রিকা প্রকাশ, গ্রেপ্তার কবি শম্ভু রক্ষিত

তথ্যসূত্র- 

১) ‘অনন্ত অম্বরে উমায়ুনের জীবন থেকে’, শারমিনা শাহদাত, রোর বাংলা
২) ‘সম্রাট হুমায়ূন’, সমরেশ মজুমদার, আনন্দবাজার পত্রিকা
৩) ‘হুমায়ূন আহমেদের নাটক ও চলচ্চিত্রে মুক্তিযুদ্ধ’, জান্নাতুল নায়েম পিয়াল, রোর বাংলা
৪) ‘দুই পারেই উন্মাদনা সৃষ্টিতে সার্থক হুমায়ূন আহমেদ’, অমিত গোস্বামী, ডেইলি বাংলাদেশ
৫) হুমায়ূন আহমেদের বাবার ছবি ঋণ - আমার ছেলেবেলা, হুমায়ূন আহমেদ

Powered by Froala Editor

আরও পড়ুন
লেখালিখির টাকায় আস্ত দ্বীপ কিনেছিলেন হুমায়ূন আহমেদ?

More From Author See More