‘অভিশপ্ত’ বই! কোথায় লুকিয়ে রহস্যে ঘেরা ‘নেক্রোনমিকন’?

স্যাম রেমি পরিচালিত ‘ইভিল ডেড’ সিনেমাটার কথা মনে আছে? হরর ফিল্মের জগতে স্যামের তৈরি এই সিনেমা একটা মাইলফলকই বটে। জঙ্গলে বেড়াতে গিয়ে এক অভিশপ্ত বই-এর সন্ধান পেয়েছিল পাঁচ বন্ধু। ‘বুক অফ দ্য ডেড’। সেই বই-এর স্তবক পাঠ করতেই জন্ম নেয় অলৌকিক নরখাদক পিশাচরা। কিন্তু বাস্তব জগতে সত্যিই কি রয়েছে এমন কোনো অভিশপ্ত গ্রন্থ? যা পাঠ করে জাগিয়ে তোলা যায় অশরীরী দানবদের?

‘নেক্রোনমিকন’ (Necronomicon)। হ্যাঁ, এই সেই আশ্চর্য কালাজাদুর মহাগ্রন্থ। মৃতের শরীরে প্রাণ ফিরিয়ে আনাই হোক কিংবা প্রাচীন দানবদের জাগিয়ে তোলার মন্ত্র ভরা আছে এই বই-এর দু’মলাটে। কিন্তু কে রচনা করেছিল এই গ্রন্থের? কোথায় গেলে বা সন্ধান পাওয়া যাবে গ্রন্থটির?

শুরু থেকেই বলা যাক ঘটনাটা। সেটা বিশ শতকের শুরুর দিকের কথা। মার্কিন লেখক এইচ ফিলিপ লাভক্রাফট (H. P. Lovecraft) তাঁর লেখা গল্প ‘দ্য হাউন্ড’-এ প্রথম এই গ্রন্থের কথা উল্লেখ করেন। এর পর তাঁর একাধিক উপন্যাস এবং গল্পে উল্লেখিত হতে শুরু করে ‘নেক্রোনমিকন’-এর নাম। তার অদ্ভুত সব মন্ত্রের কথাও অল্প-বিস্তর উল্লেখ করেছিলেন লাভক্রাফট। ১৯২৭ সালে এই বইটির সম্পর্কে একটি কল্প-ইতিহাসও লেখেন তিনি। ১৯৩৮ সালে তাঁর মৃত্যুর পর প্রকাশ্যে আসে এই গ্রন্থ। আর তারপরেই রীতিমতো সাড়া পড়ে যায় ‘নেক্রোনমিকন’ নিয়ে। 

এই গ্রন্থের উৎস এবং উপস্থিতি সম্পর্কে জীবিত অবস্থায় তাঁকে একাধিকবার সম্মুখীন হতে হয়েছিল সাংবাদিকদের প্রশ্নের। তবে প্রতিবারই তিনি উত্তর দিয়েছেন, স্বপ্নে তাঁর মাথায় এসেছিল এই গ্রন্থের নাম। স্বপ্নেই তিনি দেখেছেন এই গ্রন্থকে। আর তা নাকি লেখা মানুষের রক্ত দিয়ে। বইটির বাঁধাই-ও মানুষের চামড়ায়। লাভক্রাফট ‘নেক্রোনমিকন’-এর অনুবাদ করেন ‘অ্যান ইমেজ অফ দ্য ল অফ দ্য ডেড’। তবে আদতে এই শব্দবন্ধটির অর্থ ‘আ বুক ক্লাসিফাইং দ্য ডেড’ বা ‘মৃত শ্রেণিবন্ধকরণের গ্রন্থ’। সে যাই হোক না কেন, লাভক্রাফটের বক্তব্য অনুযায়ী এই গ্রন্থ সম্পূর্ণ কাল্পনিক। কিন্তু তার পরেও এই গ্রন্থ নিয়ে বিতর্ক কেন?

আরও পড়ুন
শুধু ‘স্যাটানিক ভার্সেস’-ই নয়, বিভিন্ন দেশে নিষিদ্ধ হতে হয়েছে এই গ্রন্থগুলিকেও

১৯৩৮ সালে লাভক্রাফটের গ্রন্থটি প্রকাশ পাওয়ার পর পশ্চিমের বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত হতে শুরু করে ‘নেক্রোনমিকন’ নিয়ে নানান প্রবন্ধ। তাতে যেমন ‘নেক্রোনমিকন’-এর কাল্পনিক নানান অংশ ও মন্ত্রের উল্লেখ থাকত, তেমনই আবার লাভক্রাফটের লেখার সঙ্গে ইউরোপে প্রচলিত কালাজাদুর মিল খুঁজতেন বিশ্লেষকরা। সেখান থেকেই সূত্রপাত বিতর্কের। কারণ, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই লাভক্রাফটের লেখার সঙ্গে হুবহু মিলে যায় ইউরোপীয় কালাজাদুর বর্ণনা, আচার, এমনকি অলৌকিক প্রেতেদের নামও। 

আরও পড়ুন
ইংল্যান্ডের বুকে স্বাধীন 'বইয়ের দেশ'! সাড়া ফেলেছিলেন বই-ব্যবসায়ী

এখানেই শেষ নয়। একদল মানুষের বিশ্বাস ছিল, এই গ্রন্থের আসল সংস্করণটি সংরক্ষিত আছে পোপের ভ্যাটিকান লাইব্রেরিতে। আবার কিছু প্রবন্ধে দাবি করা হয়, এই গ্রন্থের আসল রচয়িতা নাকি আবু আলি আলহাজরেদ নামের এক ব্যক্তি। যিনি মধ্যযুগীয় ইউরোপে পরিচিত ছিলেন ‘হাফ-ক্রেজড আরব’ বা ‘দ্য ম্যাড আরব’ নামে। নবম শতকে আরবের ‘ইরাম’-খ্যাত এক শহরে গা ঢাকা দিয়ে নেক্রোনমিকন রচনা করেন তিনি। অবশ্য তাঁর রচিত গ্রন্থটির নাম ছিল ‘আল আজিফ’। পরবর্তীতে তা গ্রিক সম্রাটদের হাত ধরে ইউরোপের প্রবেশ করে। 

আরও পড়ুন
পৃথিবীর ইতিহাসে অন্যতম মহামূল্যবান গ্রন্থের সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে অভিশাপও!

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় গুজব ছড়ায় এই বইটি পৌঁছে গেছে হিটলারের হাতে। আর সেই জাদুশক্তিতেই বিশ্বজয় করতে চলেছেন তিনি। ধ্বংস করছেন একের পর এক শহর। আবার কেউ দাবি করেছিলেন জারতন্ত্রী রাসপুতিনও নাকি হাতে পেয়েছিলেন এই গ্রন্থকে। সে যাই হোক না কেন, বহু দেশ সে-সময় লাভক্রাফটের বইটি নিষিদ্ধ করেছিল কিছুদিনের জন্য। পরবর্তীতে, বিশেষত ষাটের দশক থেকে এই আশ্চর্য গ্রন্থের একাধিক প্রকাশনা নেক্রোনমিকনের ভিন্ন ভিন্ন সংস্করণ প্রকাশ করতে শুরু করে। সঙ্গে আশ্চর্য সব দানবের ছবি। বহু সিনেমারও প্রেক্ষাপটে জায়গা করে নেয় নেক্রোনমিকন। আশ্চর্যের বিষয় হল, আজও কিছু মানুষের বিশ্বাস, কোনো এক গোপন কুঠুরিতে লুকিয়ে রাখা আছে এই অভিশপ্ত গ্রন্থ। আজও তার সন্ধান করে চলেছেন অসংখ্য মানুষ। আসলে অসীম ক্ষমতার অধিকারী কে না হতে চায়?

Powered by Froala Editor