বিশ শতকের সবচেয়ে ‘বুদ্ধিমান’ ব্যক্তিত্ব বলা হয়েছিল তাঁকে

কথাটা যিনি বলেছিলেন তিনি হচ্ছেন আন্দ্রে ব্রেতোঁ। ১৯২৪ সালের ‘সুররিয়ালিস্ট ম্যানিফেস্টো’-র আসল চক্রী ছিলেন বুদ্ধিজীবী শিল্পী আন্দ্রে। যাকে সেরা বুদ্ধিমানের আখ্যাটা দিয়েছিলেন, সেই ভদ্রলোক কিন্তু তেমন আপত্তি করেননি শুনে। আবার সাগ্রহে আখ্যাটা মেনেও নিয়েছেন, এমনও বলা  যায় না। ...‘হ্যাঁ, খুবই বন্ধুত্ব ছিল ঐসময় ব্রেতোঁ-র সঙ্গে’, জানাচ্ছেন  উনআশি বছরের মার্সেল দুশাঁ। ১৯৬৬ সালে খেপে খেপে সাক্ষাৎকারটি নিয়েছিলেন পিয়ের কাবানে। এগুলি নিয়েই পরে একটি ছিমছাম বই বেরোবে, ‘ডায়লগস উইদ মার্সেল দুশাঁ’ শিরোনামে।

বইয়ের ভূমিকা লিখেছেন রবার্ট মাদারওয়েল, সেরা এক বিমূর্ত এক্সপ্রেশনিস্ট শিল্পী। মার্সেল দুশাঁ, যিনি সর্বদা গোলাপি শার্ট পরেন,  চুরুট খান, ভুলেও কোনও আর্ট একজিবিশনে যান না, (যদিও শিল্পী হিসেবেই খ্যাতি), তাঁকে নিয়ে মাদারওয়েলের মন্তব্য, ‘দা ভিঞ্চি-ও বুদ্ধিমান ছিলেন, কিন্তু বিশ্বাসী-ও ছিলেন। দুশাঁ বিশ্বাস টিশ্বাসের বাইরে চলে গেছেন, হয়ে গেছেন চরম সেকুলার ও একাচোরা... চলতি নান্দনিকতা ছাপিয়ে নিজের ‘এথিকস’ খুঁজে পেয়েছেন ভদ্রলোক।’

‘প্যারিসে গোড়ার দিকে ১৭ জন লোক হয়তো দুশাঁ-র ‘রেডিমেড শিল্প’ বুঝত’, সালভাদোর দালির কথায়,  ‘এখন বিশ্বের ১৭ মিলিয়ন লোক সেগুলো বুঝতে পারে। এমন দিন আসবে, সমস্ত বস্তু যখন ‘রেডিমেড শিল্প’ বলেই বিবেচ্য হবে, ‘শিল্প’ বলে তখন কিছু থাকবেই না আর।’

দাদাইস্টদের দলের এক তরুণ তুর্কি দুশাঁ শিল্পের ইতিহাসে কুখ্যাততম কাণ্ড ঘটান একটা একজিবিশনে ভাস্কর্য হিসেবে হিসি করার বেসিন রেখে দিয়ে, যার কথা আজ অনেকেই শুনে থাকবেন (কাজটির নাম ছিল ‘ফাউন্টেন’।) মোনালিসার মুখে সরু গোঁফ আর ছাগল দাড়ি এঁকে দেওয়া (তলায় লেখা ‘চমৎকার নিতম্ব বটে ভদ্রমহিলার’) কিংবা টুলের ওপর সাইকেলের চাকা বসিয়ে একজিবিশনে চালানো, সবেরই মূলে হচ্ছেন তরুণ মার্সেল। ‘তখন কম বয়স, মাত্র উনত্রিশ বছর’, বলছেন দুশাঁ, ‘ডিসেন্ডিং নুড অন স্টেয়ারকেস যখন আঁকি। আমেরিকায় ঐ ছবিটা অনেকেই দেখলে চিনবে, হয়তো নামও জানে। কিন্তু আমি একটা টোটাল অচেনা লোক এখানে। দুশাঁ বলে কাউকে চেনে না এরা। ছবিটা নিজে নিজেই বিখ্যাত হয়েছে।’

আরও পড়ুন
দেশের কাজে, সমাজের কাজে সোমেন চন্দের ত্যাগ, ঐকান্তিকতা প্রশ্নাতীত : দিলীপ মজুমদার

গ্যালারিতে যান আর? প্রশ্ন করলে মাথা নাড়েন দুশাঁ, ‘একদমই না। শেষ কবে ল্যুভর মিউজিয়মে গেছি জানো? কুড়ি বছর আগে। ...এখন ঘরেই থাকি, মিশিটিশি না কারও সাথে, বন্ধুও আর নেই সেরম। ব্রেতোঁ-র সাথে আগে দেখা হত।... আমার অবাকই লাগে যখন আমার আদ্যিকালের কাজগুলো নিয়ে তাত্ত্বিক ঐতিহাসিকরা কথা বলছে দেখি। আমি তো উৎসাহই হারিয়ে ফেলেছি শিল্পের ব্যাপারে।’

আরও পড়ুন
স্বপ্ন, সন্তান, শিশুশ্রম - এক গতানুগতিক হেরে যাওয়া আমাদের

শিল্পের ভবিষ্যৎ নিয়ে কী বলবেন? ‘যা চেয়েছিলাম তা তো অ্যানটি-শিল্প, চলতি এস্থেটিক-কে ধ্বংস করা। আমার মনে হয় না, শিল্প জিনিসটার আর তেমন অস্তিত্ব আছে, যেভাবে ভাবা হয় আর কি। একটা লোক যেমন মারা যায়, তেমন একটা পেইন্টিংও কি মরে যায় না? তুমি কি নিশিচত একটা ইমপ্রেশনিস্ট ছবি আঁকবার ঠিক পরে যেমন তরতাজা ছিল, এখন ‘ক্লাসিক’ হিসেবে জাদুঘরে টাঙিয়ে দেওয়ার পর তার সেই চার্ম আছে?’  

আরও পড়ুন
আমফান-দুর্গতদের পাশে যাদবপুরের পড়ুয়ারা, সাক্ষাৎকার দিলেন নোয়াম চমস্কি

‘রাজনীতি নিয়ে আর কী বলব,’ দুশাঁ-র গলা কি একটু তেতো? ...‘রাজনীতি করো, সে খুব ভালো কথা, কিন্তু এটাও তো একটা কাজই। একটা সামাজিক কাজ, তাই তো? আর তো কিছু না! এদের ভাবগতিক থাকে যেন মহান কিছু ক’রে সমাজকে উদ্ধার করছে! এই আদেখলামি মন থেকে অপছন্দ করি।’      

আরও পড়ুন
স্বদেশকে চিনতে গেলে দেবেশদার লেখার কাছে ফিরতেই হবে

‘হ্যাঁ, পাবলিকের একজন স্টার তো লাগেই। পিকাসো যেমন একজন। যেমন আইনস্টাইন, পদার্থবিদ্যার স্টার।... পিকাসোর সাথে মাত্র তিনবার দেখা হয়েছে। বরং ঘনিষ্টভাবে চিনতাম পিকাবিয়া-কে। পিকাসো যেমন ধরো কিউবিজমটা কিচ্ছু ব্যাখ্যা করেনি, পিকাবিয়া সেরম ছিল না। ও ধরে ধরে বুঝিয়েছে। শিল্পী হিসেবে ওর তেমন কিছু হল না, এটা বেশ অবাক লেগেছিল’, স্মৃতি হাতড়ে যাচ্ছেন দুশাঁ।

অন্যদের নিয়ে কী বলবেন? –‘অন্যদের বলতে দালি, মাগরিৎ, বিশেষত চিরিকো, সব্বাই খুব শক্তিমান। ...মাতিস? হ্যাঁ, মাতিসকে খুবই জরুরি মনে হয়। অসম্ভব জরুরি আমার জন্যে। ...আমার ‘চেস প্লেয়ার’ নামে ছবিটা, হ্যাঁ, ওটা সেজান থেকেই নেওয়া আর কী, ‘কার্ড প্লেয়ার’ নামে ওনার ছবিটা থেকে প্রায় উদ্ধৃত... তবে পেইন্টিং তো আমি বেশি করিনি। সকালে আঁকা, দুপুরে আঁকা, রাত্তিরে... এসব আমার কোনোদিনই পোষায় নি,’ অকপট স্বীকারোক্তি বৃদ্ধের।

‘কুখ্যাত কাজকর্ম বেশ কিছু করেছিলাম। নিজের নামে ওয়ারেন্ট বের করা, আরো নানা ঠাট্টা শিল্প নিয়ে... ‘নুড ডিসেন্ডিং’ ছবিটা যেমন একজিবিশনে রাখতে অস্বীকার করেছিল। এরা সংস্কারহীনতার কথা বাইরে বলে টলে, আসল জিনিস দেখে পিছিয়ে যায়।’  

‘সিনেমা কালেভদ্রে দেখি। গোদারের মাস্কুলা ফেমিনা যেমন দেখলাম সম্প্রতি। আধুনিক উপন্যাস... না, ওসব পড়তে গিয়েও পারিনি তেমন। রোব গ্রিয়ে, মিশেল বুতর, কোনোটাই না। সেই মালার্মেই পড়ি এখন, আর তেমন কিছু না। ওর ইম্প্রেশনিজম অনেকটা জর্জ সুরা-র মতো মনে হয়, র্যাঁ বো-র চেয়েও সরল, তাছাড়া র্যাঁ বোও তো মুলত ইম্প্রেশনিস্টই...।  সত্যি বলতে বই খুবই কম  পড়া হয়। ...দাবাটাই বলতে পারো খুব প্যাশন ছিল, যদিও জানি এটা বুদ্ধিমান আর কুঁড়ে লোকের একটা ভালো অজুহাত’... বলে রাখা উচিত দুশাঁ আজীবন দাবা খেলা নিয়ে আচ্ছন্ন ছিলেন, প্রধানত এর শুদ্ধ গাণিতিক ফর্মের টানেই।

‘ভগবান? প্রশ্নই ওঠে না’, সবেগে নাকচ করছেন বৃদ্ধ শিল্পী, ‘আস্তিক নাস্তিকের ব্যাপার নয়। ভগবান একটা অফ টপিক। ধরো তুমি বা আমি কি রোববার সকাল বেলা ‘মৌমাছিরা কেমন ভাবে কী করে’ সেই নিয়ে কথা বলতে বসি? ভগবানও সেইরকম ব্যাপার। মানুষের কথা বলার সাবজেক্ট না। আলাদা ডাইমেনশনের ব্যাপার।... আর্ট শব্দটা পছন্দ করি না, সংস্কৃত ভাষায় ‘শিল্প’ মানে হচ্ছে ‘কিছু বানানো’ (‘To make’)। এই ‘বানানো’ ক্রিয়াপদটা বরং মানা যায়। টেকনিশিয়ান বলতে পারো, অসুবিধা নেই। আর্টিস্ট একটা বিচ্ছিরি শব্দ। ’

আধুনিক শিল্পের আফাঁ তেরিবল মার্সেল দুশাঁ মারা যান এই সাক্ষাৎকার দেওয়ার দু বছর পর, একাশি বছর বয়সে। নিজের কাজ নিয়ে নিজে তেমন উৎসাহী ছিলেন না, শিল্প নিয়েও ছিল না আদিখ্যেতা, তবু তাঁর স্বল্প সংখ্যক কাজ নিয়ে এখনও চর্চা কিছু কমতি না। ‘আর্টের সংজ্ঞাই বদলে দিয়েছেন দুশাঁ’, মনে করেন তামাম শিল্প ঐতিহাসিক ও তাত্ত্বিকেরা, ‘আধুনিক শিল্প তাঁকে ছাড়া হত না কিছুতেই।’

...নিজের সম্পর্কে বৃদ্ধের নিরভিমান মন্তব্য ছিল, ‘জীবন নিয়ে আমি সুখী। সেভাবে দেখলে খুবই সৌভাগ্যবান আমি। কাজ না করেও এখনও প্রাসঙ্গিক আছি...! না, কোনও দুঃখ নেই। অনুতাপ, তাও না। পরিপূর্ণ সুখী আমি। ...রেস্তোরাঁ-র বেয়ারার মতোই আমি জীবনটা কাটিয়েছি বলতে পারো।’ 

Dialogues with Marcel Duchamp

Translated from French by Ron Padgett 

Powered by Froala Editor