বিজয়ের আনন্দে মাতোয়ারা গোটা বাংলাদেশ, খুলনা তখনও লড়ছে স্বাধীনতার জন্য

একাত্তরের রক্তের দাগ এখনও শুকোয়নি বহু উঠোনে। হিংস্র পাকিস্তানি সেনার সেদিনকার বর্বরতার ছবি ভুলতে পারেননি অনেকেই। মুক্তিযুদ্ধ বাংলাদেশের ইতিহাসে এক চিরকালীন সোনালি দিন নিঃসন্দেহে। কিন্তু আশ্চর্য হতে হয় জেনে, গোটা বাংলাদেশে একই দিনে স্বাধীনতা আসেনি। ১৬ই ডিসেম্বর বাংলাদেশের সর্বত্র বিজয় দিবস পালিত হলেও, খুলনা ১৬ই ডিসেম্বর পাকিস্তানি অত্যাচার থেকে রেহাই পায়নি। সেখানকার সার্কিট হাউসে বাংলাদেশের পতাকা উড়েছিল ১৭ই ডেসেম্বর। এক দিন পরে। যদিও খুলনা বিভাগের মুক্তিযুদ্ধ সার্বিক মুক্তিযুদ্ধের থেকে আলাদা কিছু ছিল না।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে, পৃথিবীর সবচেয়ে ভয়াবহ যুদ্ধ বলা হয় বাংলাদেশের এই মুক্তিযুদ্ধকেই।  মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি রক্তবিন্দুর বিনিময়ে ছিনিয়ে নেওয়া স্বাধীনতা থমকে গেছিল খুলনা শহরে এসে। কিন্তু কেন? জানতে হলে শরণ নিতে হবে ইতিহাসেরই।

এই যে একদিন পরে এসেছিল স্বাধীনতা, এর পিছনে লুকিয়ে আছে 'ট্যাঙ্ক ব্যাটেল অব শিরোমণি'। তার রূদ্ধশ্বাস অপেক্ষা। মুক্তিযোদ্ধাদের দৌরাত্ম্যে গোটা দেশে একের পর এক আত্মসমর্পণ করে পাকিস্তান সৈন্য। হ্যাঁ শুধু নিরাপত্তার স্বার্থেই। কিন্তু কোনোভাবেই খুলনা হাতছাড়া করতে চাইছিল না তারা। সেসময় পাকিস্তানি হানাদাররা গল্লামারী রেডিও স্টেশন, খুলনা লায়ন্স স্কুল, পি এম জি কলোনি, শিপইয়ার্ড, ৭নং ঘাটের জেটি, বয়ড়া ফায়ার ব্রিগেড স্টেশন, গোয়ালপাড়া বিদ্যুৎ কেন্দ্র, দৌলতপুর সহ একটা বিস্তীর্ণ এলাকায় ছড়িয়ে ছিল। মুক্তিযোদ্ধারা তড়িঘড়ি সিদ্ধান্ত নেন খুলনায় প্রবেশের। চারিদিক থেকে ঘিরে নিয়ে, প্রবেশপথে সশস্ত্র মোকাবিলার জন্যও প্রস্তুত ছিলেন তাঁরা। এমনও শোনা যায় যে, পাকিস্তানের সাহায্যে এসেছিল মার্কিন সপ্তম নৌবহর। যা ছিল মংলার কাছেই। তাই পাকিস্তানি সেনা যেনতেন প্রকারে চাইছিল শিরোমণি হয়ে মংলায় পৌঁছাতে।

কিন্তু ফাহিমউদ্দিন, লে নোমান উল্লাহ, বোরহান উদ্দিন, শাহজাহান মাস্টার, আফজাল ও কুতুবউদ্দিনের নেতৃত্বে একের পর এক পাক ঘাঁটিতে আক্রমণ চালিয়ে খুলনায় প্রবেশ করেন বাংলার মুক্তিযোদ্ধারা।

১৬ই ডিসেম্বর, ঢাকার সোহরাওয়ার্দি উদ্যানে পাকিস্তান বশ্যতা স্বীকার করলেও খুলনাতে তখনও পৌঁছোয়নি তার রেশ। বিচ্ছিন্নভাবে যুদ্ধ চলছিলই। সেদিনই যশোর রোড ধরে খুলনা আসার রাস্তায় শিরোমণিতে যুদ্ধ চরম আকার নেয়। পাকিস্তানি বাহিনীর সঙ্গে যুদ্ধে দু'পক্ষেরই প্রচুর নিহত হয়। হিংসার আঁচ বাড়তে থাকে। ১৭ ডিসেম্বর ভোরে রূপসা নদীর ধারে শিপইয়ার্ড সংলগ্ন ধানক্ষেতে শুরু হয় এক নাছোড় মুক্তি সংগ্রাম। আহত, নিহতের সংখ্যা বাড়তে থাকে। শেষমেশ সব পেরিয়ে সকাল হতেই বাংলার মুক্তিযোদ্ধারা খুলনা শহরে ঢুকে পড়েন। পাক সেনারা বাধ্য হয় আত্মসমর্পণে। প্রথমেই সার্কিট হাউস দখল করে স্বাধীন মুক্ত বাংলার গর্বের পতাকা উড়িয়ে দেওয়া হয়। যৌথভাবে মেজর জয়নাল আবেদিন ও রহমত উল্লাহই উত্তোলন করেন দেশের স্বাধীনতার নিশান। বাইরে তখন শুধু মানুষের ঢল। স্বাধীন বাংলার মুক্তির আনন্দে আত্মহারা সবাই।

পরবর্তীতে ১৬ই ডিসেম্বরকে 'বিজয় দিবস' ঘোষণা করে খোদ বাংলাদেশ সরকার। কিন্তু সেই রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের পরেও চলেছিল খুলনার স্বাধীনতা যুদ্ধ। তার গায়ে লেগে থাকা সমস্ত রক্তে মুক্তির কথা লিখে রাখা দিন ১৭ই ডিসেম্বর। ভুলে যায়নি খুলনাবাসী। ভুলে যায়নি বাংলাদেশ।

Powered by Froala Editor

More From Author See More