সাম্প্রদায়িক বৈষম্য দূর করতে ‘মানব লাইব্রেরি’ যুক্তরাষ্ট্রে

অপরিচিত কোনো জায়গায় ঘুরতে গিয়ে লাইব্রেরির হদিশ পেলেও ঢুঁ মারেন না, এমন বইপোকা এ-জগতে নেই বললেই চলে। তবে যুক্তরাষ্ট্রের ইন্ডিয়ানা প্রদেশের মুন্সি শহরে অবস্থিত ‘হিউম্যান লাইব্রেরি’-তে গেলে প্রাথমিকভাবে হতাশ হতে হবে যে কাউকে। না, হেল্পডেস্কে গিয়ে হাজার খোঁজ করলেও পছন্দের বই পাবেন না। বরং, মধ্যবয়স্ক এক ভদ্রলোক হাতে ধরিয়ে দেবে লম্বা ক্যাটালগ। তাতে সার দিয়ে ছাপার অক্ষরে লেখা রয়েছে বেশ কিছু মানুষের নাম। পদবি সহ। সেইসঙ্গে রয়েছে তাঁদের লিঙ্গ পরিচয়ও। 

অবাক হচ্ছেন? হ্যাঁ, হওয়াটাই স্বাভাবিক। কারণ, আক্ষরিক অর্থেই ‘হিউম্যান লাইব্রেরি’ (Human Library) মানব গ্রন্থাগার। ছাপা বই নয় বরং জীবন্ত মানুষরাই স্বয়ং এই মার্কিন গ্রন্থাগারের সম্বল। আজ থেকে ২১ বছর আগের কথা। ২০০০ সালে ড্যানিশ মানবাধিকার কর্মী ও সাংবাদিক রনি আবারগেলের উদ্যোগে তৈরি হয়েছিল এই ‘মানব গ্রন্থাগার’। রনির জন্ম এবং বেড়ে ওঠা ডেনমার্কে হলেও, পড়াশোনার সূত্রে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে চলে আসা কৈশোরের গণ্ডি পেরনোর পরেই। তারপর সাংবাদিকতার জেরে হয়ে ওঠা আমেরিকার স্থায়ী বাসিন্দা।

তখনও স্কুল পড়ুয়া তিনি। ডেনমার্কের কোপেনহেগেনে বর্ণবৈষম্যের জেরে ছুরিকাঘাতে আক্রান্ত হয়েছিলেন তাঁরই এক বন্ধু। সেই সময় থেকেই মানবাধিকার আন্দোলনের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন রনি। বেছে নেন বৈষম্য এবং সহিংসতার বিরুদ্ধে প্রতিবাদের পথ। আমেরিকায় চলে আসার পর, তাঁর চোখের সামনে ভেসে ওঠে বৈষম্যের আরও জটিল এবং অন্ধকার এক জগৎ। কৃষ্ণাঙ্গ সম্প্রদায়ের প্রতি হিংসা, অবিচারের প্রত্যক্ষ সাক্ষী হন রনি। সেইসঙ্গে তাঁকে ভাবিয়ে তুলেছিল পক্ষপাতদুষ্ট রাজনৈতিক আবহাওয়া। ভিনদেশে এসে তাই প্রতিবাদের পথ থেকে সরে আসতে পারেননি রনি। শুরু করেছিলেন আন্দোলন। তবে বেশ ভালোই বুঝেছিলেন সাধারণ মানুষকে সচেতন না করতে পারলে, তাঁদের সামনে এই হিংসা ভয়াবহতা তুলে না ধরতে পারলে ঠেকানো সম্ভব নয় এই বিদ্বেষকে। আর সেখান থেকেই অভিনব এই ‘মানব গ্রন্থাগার’ তৈরির পরিকল্পনা তাঁর। 

মুন্সি শহরের এই লাইব্রেরির মানব-গ্রন্থরা স্বয়ং এক-একটি গল্প, উপন্যাস। তাঁদের কেউ কেউ নিজে শিকার হয়েছেন সাম্প্রদায়িক কিংবা বর্ণবিদ্বেষমূলক হিংসার। কাউকে আবার এলজিবিটি পরিচয়ের জন্য একঘরে করেছে সমাজ। লাইব্রেরির ‘গ্রন্থতালিকায়’-য় রয়েছেন যৌননির্যাতিত, শরণার্থী এবং কারাগার থেকে ফিরে আসা অপরাধীরাও। তাঁদের জীবনের লড়াকু মানসিকতা এবং ভয়াবহ ঘটনাগুলিকেই মানুষের সামনে তুলে ধরেই একমাত্র উদ্দেশ্য রনির। 

আরও পড়ুন
পুলিশের উদ্যোগে, ৪৫০০ বই নিয়ে আউটপোস্টেই তৈরি লাইব্রেরি

সব মিলিয়ে তাঁর লাইব্রেরিতে এখন মানব-গ্রন্থের সংখ্যা হাজারেরও বেশি। আমেরিকার শহরগুলিতে তো বটেই সেইসঙ্গে ৮০টিরও বেশি দেশের লাইব্রেরি, জাদুঘর, স্কুল এবং বিভিন্ন ফেস্টিভালেও অস্থায়ীভাবে লাইব্রেরির পরিষেবা প্রদান করে থাকে ইন্ডিয়ানা প্রদেশের ‘হিউম্যান লাইব্রেরি’। পরিষেবা পাওয়া যায় ৫০টিরও বেশি ভাষায়। ফলে, সচরাচর অনুবাদকেরও প্রয়োজন পড়ে না। সেক্ষেত্রে কোনো নির্দিষ্ট সময়ে একজন মানব-গ্রন্থের পাঠক, থুড়ি শ্রোতা থাকেন একজনই। তাঁর সঙ্গেই পাঠকের আলোচনা চলে ঘণ্টা খানেক। 

আরও পড়ুন
১১৮টি পঞ্চায়েতেই লাইব্রেরি, বিরল নজির ঝাড়খণ্ডের জামতাড়ায়

রনি আবারগেলের এই লাইব্রেরি উদ্যোগ এখন প্রায় ‘বেস্টসেলার’ হয়ে উঠেছে সানফ্রান্সিসকো, শিকাগোর মতো শহরে। অন্যান্য দেশেও খুলেছে একাধিক শাখাও। শাখা রয়েছে কলকাতাতেও। তবে দু’দশক পেরিয়ে আসার পরেও আজও বিশ্বের একমাত্র মানব গ্রন্থাগার এই ‘হিউম্যান লাইব্রেরি’। সামগ্রিকভাবে বৈষম্য দূরীকরণ ও সাধারণ মানুষকে সচেতন করতে আরও এই ধরনের উদ্যোগ নেওয়া হলে বদলে যেত আজকের সমাজের ছবিটাই…

আরও পড়ুন
ক্যানসার-আক্রান্তদের জন্য লাইব্রেরি তৈরি ৯ বছরের বালিকার

Powered by Froala Editor

Latest News See More