পৃথিবীর ইতিহাসে অন্যতম মহামূল্যবান গ্রন্থের সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে অভিশাপও!

রুবাইয়াৎ-ই-ওমর খৈয়াম। বাঙালি বইপোকারা অনেকেই পরিচিত এই গ্রন্থের সঙ্গে। গ্রন্থটি মূলত মধ্যযুগীয় পারস্যের কবি, জ্যোতির্বিদ এবং শিক্ষাবিদ ওমর খৈয়ামের লেখা একগুচ্ছ রুবায়াৎ অর্থাৎ চার লাইনের কবিতার অনুবাদ। যা আরবি থেকে অনুবাদ করেছিলেন স্বয়ং কাজী নজরুল ইসলাম। তবে শুধু নজরুলই নয়, উনিশ শতকের শেষ দিক থেকেই এই ওমর খৈয়ামের রুবাইয়াৎ আকৃষ্ট করেছে অস্কার ওয়াইল্ড-সহ একাধিক সাহিত্য ব্যক্তিত্বকে। 

ওমর খৈয়ামের রুবাইয়াৎকে ইউরোপে জনপ্রিয় করে তুলেছিলেন ব্রিটিশ কবি এডওয়ার্ড ফিটজেরাল্ড (Edward Fitzgerald)। পারসিয়ান সাহিত্যের এই রত্নভাণ্ডারকে অনূদিত করেছিলেন ইংরাজিতে। ১৮৮৪ সালে প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল সেই বই। প্রাথমিকভাবে তা বিক্রি না হলেও, ধীরে ধীরে গোটা ব্রিটেনেই সমাদৃত হয় ফিটজেরাল্ড অনূদিত ‘দ্য গ্রেট ওমর’ (The Great Omar)। 

প্রায় হাজার বছর পুরনো রুবাইয়াৎ এবং ওমর খৈয়ামকে নিয়ে এত কথা বলার কারণ আর কিছুই নয়, ‘দ্য গ্রেট ওমর’ বইটিকেই বিশ্বের সবচেয়ে অভিশপ্ত গ্রন্থ (Most Cursed Book) হিসাবে বিবেচনা করেন কনস্পিরেসি থিওরিস্টরা। সেই গল্পেই ফেরা যাক বরং।

১৮৯০-এর দশকে লন্ডনের বই-বাজারে সবচেয়ে বেশি বিক্রিত অনূদিত গ্রন্থ ছিল ‘দ্য গ্রেট ওমর’ বইটিই। এমনকি ওমর খৈয়াম জনপ্রিয়তা এতটাই বৃদ্ধি পেয়েছিল যে ১৯৯২ সালে ব্রিটেনের বুকে গড়ে উঠেছিল একটি বিশেষ ক্লাব। যা ওমর খৈয়ামের সাহিত্যের পাঠ দিত সাধারণ মানুষদের। 

আরও পড়ুন
বই কেন ঝাড়ে

খৈয়ামের এই ক্রমবর্ধমান জনপ্রিয়তাকে মাথায় রেখেই ‘দ্য গ্রেট ওমর’ গ্রন্থের একটি বিশেষ সংস্করণ ছাপানোর উদ্যোগ নেন ব্রিটিশ প্রকাশক জর্জ সাটক্লিফ এবং ফ্রানসিস স্যানগোর্স্কি। ১৯০৮ সালে শুরু হয় এই গ্রন্থ প্রকাশের কাজ। আক্ষরিক অর্থেই এই গ্রন্থ ছিল সাক্ষাৎ রত্নভাণ্ডার। না, শুধু সাহিত্যগুণের জন্য নয়। এই গ্রন্থের বাঁধাই-ই অনন্য করে তুলেছিল তাকে। 

আরও পড়ুন
নিষিদ্ধ বইয়ের জাদুঘর, ইতিহাসের খণ্ডচিত্র ধরে রেখেছে এস্তোনিয়া

রুবি, টোপাজ, গারনেট, ফিরোজা-সহ প্রায় হাজারেরও বেশি দামি মণিমাণিক্য দিয়েই সাজানো হয়েছিল গ্রন্থটির প্রচ্ছদ। সেইসঙ্গে ব্যবহৃত হয়েছিল ২২ ক্যারেটের সোনার ৬০০টি পাত। তা দিয়েই প্রচ্ছদে ফুটিয়ে তোলা হয়েছিল তিনটি ময়ূরের প্রতিকৃতি। ব্যাক কভারে ছিল স্বর্ণপাতে তৈরি ম্যান্ডলিন গোত্রের একটি গ্রিক বাদ্যযন্ত্রের ছবি। যা স্থানীয় ভাষায় পরিচিত বুজুকি নাএ। তাছাড়াও গ্রন্থের অলঙ্করণে ব্যবহৃত হয়েছিল অজস্র রৌপ্য পাত এবং আমেরিকান এলেহু ভেডারের আঁকা ছবি। সবমিলিয়ে গ্রন্থটির প্রচ্ছদ তৈরিতেই সময় লেগেছিল তিন মাস। আরও আরও দু’বছর সময় লাগে বইটি বাঁধাই করতে।

আরও পড়ুন
একই সময় একই নাম গল্প দুটি আর 'তিন রকম' বই

তৎকালীন সময়ে ইউরোপের অন্যতম মূল্যবান গ্রন্থ ছিল ‘দ্য গ্রেট ওমর’-এর এই সংস্করণটি। শেষ পর্যন্ত এক মার্কিন বাণিজ্যপতি নিলামে এই বইটি কেনেন ৫ হাজার মার্কিন ডলারে। যা বর্তমান সময়ে প্রায় ২ লক্ষ মার্কিন ডলারের সমতুল্য। বইটি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে পৌঁছে দেওয়ার জন্য কাস্টম মূল্য হিসাবে তাঁকে খরচ করতে হয় আরও হাজার ডলার। ফলে, নিউইয়র্ক টাইমসের মতো পত্রিকার প্রথম পাতাতেও জায়গা করে নিয়েছিলও এই সংবাদ। তবে দুঃখের বিষয়, এত কিছুর পরেও বইটি হাতে পাননি ওই মার্কিন ব্যক্তি। 

১৯১২ সালে ‘দ্য গ্রেট ওমর’-এর এই সংস্করণটি ঐতিহাসিক টাইটানিক জাহাজে চেপেই পাড়ি জমিয়েছিল যুক্তরাষ্ট্রের দিকে। তারপরই সেই বিপর্যয়। টাইটানিকের সঙ্গেই আটলান্টিকের বুকে চিরতরে হারিয়ে যায় ঐতিহাসিক গ্রন্থটি। 

তবে এখানেই শেষ নয়। গ্রন্থ প্রকাশক জর্জ সাটক্লিফের তত্ত্বাবধানে তিরিশের দশকে প্রকাশিত হয়েছিল এই গ্রন্থের আরও একটি অনুরূপ দ্বিতীয় সংস্করণ। যা রাখা হয়েছিল ব্রিটেনের ব্যাঙ্ক অফ লন্ডনের একটি ভল্টে। তবে নিয়তি ছাড়েনি সেটিকেও। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জার্মান বোমারু বিমানের বোমা হামলার শিকার হয় ‘দ্য গ্রেট ওমর’। আশ্চর্যজনকভাবেই সেবার ফেটে গিয়েছিল লোহার ভল্ট। আগুনে ছাই হয়ে যায় গ্রন্থটি। 

বিশ্বযুদ্ধের পর বইটির তৃতীয় সংস্করণ তৈরির কাজ শুরু করেছিলেন সাটক্লিফ। তবে কয়েক মাসের মধ্যেই মৃত্যু হয় তাঁর। বইটির প্রকাশনের কাজ শেষ করেন তাঁরই ভাগ্নে স্ট্যানলি ব্রে। তবে আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকাশ করা সুযোগ পাননি তিনিও। আকস্মিক হৃদরোগেই মৃত্যু হয় তাঁর। 

না, ‘দ্য গ্রেট ওমর’ আর কোনো পাঠক খুঁজে পাননি। তার জন্য দায়ী ছিল একের পর এক এই অস্বাভাবিক ঘটনাগুলিই। ১৯৮৯ সালে গ্রন্থটি ব্রিটিশ লাইব্রেরির হাতে তুলে দেয় সাটক্লিফের পরিবার। বর্তমানে সেখানে সংরক্ষিত রয়েছে মহামূল্যবান তথা অভিশপ্ত এই গ্রন্থ…

Powered by Froala Editor