কলকাতার বুকেই লুকিয়ে ‘ঘনাদা ক্লাব’, আসতে চলেছে ৭৫ বছরের বিশেষ সংকলনও

রোগা, লম্বা, হাড় বার করা এক বাঙালি ভদ্রলোক। তাঁর বয়স ঠিক আন্দাজ করা যায় না। সে পঁয়ত্রিশও হতে পারে, আবার পঞ্চান্নও। আবার দুশো বছর হওয়াও অস্বাভাবিক কিছু না। ৭২ নম্বর বনমালী নস্কর লেনের মেসেই থাকেন এই অদ্ভুত মানুষটি। আড্ডা দিতে আসত আরও চারজন— শিবু, শিশির, গৌর আর সুধীর। আর তাঁদেরই মধ্যমণি, শ্রী ঘনশ্যাম দাস। ওরফে ঘনাদা…

বাংলা সাহিত্যের উঠোনে যে সব কালজয়ী ‘দাদা’রা রাজত্ব করেছেন, তাঁদের মধ্যে ঘনাদা বোধহয় নিজের গুণেই স্বতন্ত্র। পৃথিবীর হেন কোনো জায়গা নেই যেখানে তিনি যাননি। আর তাঁর সঙ্গে ঘটেনি এমন ঘটনা নাকি পৃথিবীতেও কোথাও ঘটেনি। কাজেই, ঘনাদা যে বেশ কেউকেটা সেটা বুঝে গিয়েছিলেন সবাই। বিদেশিরা তাঁকে ‘ডস’ নামে চেনে। সেই ঘনাদাই নাকি ৭৫ বছরে পড়লেন! 

খটমট লাগল? ঘনাদার আবার বয়স! হেসে ফেললেন ডঃ দিলীপ সোম। “না না, ঘনাদার আবার বয়স হয় নাকি! বলা ভালো, ঘনাদার আবির্ভাবের ৭৫ বছর পূর্তি হচ্ছে। ১৯৪৫ সালে দেব সাহিত্য কুটিরের পূজাবার্ষিকীতে প্রথমবার আবির্ভূত হলেন ঘনাদা। প্রেমেন্দ্র মিত্রের সেই ‘মশা’ গল্প থেকেই শুরু পথ চলা।” সেই হিসেবে তো ৭৫-ই বটে। বাংলা সাহিত্যের কালজয়ী এক চরিত্রকে সবরকমভাবে উদযাপন করার জন্যই আসতে চলেছে ‘ঘনাদা ৭৫’ বিশেষ সংকলন। আর এই বিশাল কাজের দায়িত্বে আছে ঘনাদা ক্লাব; যার মূল উদ্যোক্তা হলেন ডঃ দিলীপ সোম।

এক মিনিট, কী বললেন? ঘনাদাকে নিয়ে আস্ত একটা ক্লাব? একদম ঠিকই শুনেছেন। অবশ্য এটা খুব সাম্প্রতিক ব্যাপার নয়। প্রেমেন্দ্র মিত্রের জীবিতকালেই, ১৯৮৬ সালের মে মাসে তাঁরই বাড়িতে প্রথম শুরু হয় ‘ঘনাদা ক্লাব’। প্রেমেন মিত্তির ছাড়াও ছিলেন লীলা মজুমদার, অজয় হোম, রবীন বল, সিদ্ধার্থ ঘোষ প্রমুখেরা। এরও তিন বছর আগে, ‘কিশোর জ্ঞান বিজ্ঞান’ পত্রিকায় চিঠি মারফৎ এই বিশেষ ক্লাবের পরিকল্পনার কথা তোলেন সিদ্ধার্থ ঘোষ। কিন্তু সেই ক্লাব বেশিদিন স্থায়ী হয়নি। 

হঠাৎ নতুন করে ঘনাদা ক্লাব শুরু করার কথা মাথায় এল কেন? কর্মসূত্রে দীর্ঘদিন প্রবাসে থাকেন ডঃ দিলীপ সোম। “এই পুরো ব্যাপারটা মাথায় আসে শার্লক হোমসের মিউজিয়ামকে দেখে। এই কিংবদন্তি চরিত্রকে ঘিরে যদি এত কিছু তৈরি হয়ে থাকে, তাহলে বাংলা সাহিত্যই বা পিছিয়ে থাকবে কেন? আর ঘনাদার মতো এমন ইউনিক চরিত্র বিশ্ব সাহিত্যে আর আছে? তাঁর হাত ধরে ইতিহাস, বিজ্ঞানের বিভিন্ন দিক জানতে পারি আমরা। ঘনাদা সবদিক থেকে প্রেমেন্দ্র মিত্রের এক অবিস্মরণীয় সৃষ্টি। তাই তাঁকে জীবন্ত করার জন্যই নতুন করে ঘনাদা ক্লাব তৈরি করা। ২০১৯ সালে মুক্তারামবাবু স্ট্রিটে আবারও ঝাঁপি খোলে ঘনাদা ক্লাব। আর সেইসঙ্গে আগমন হয় ওয়েবসাইট হিসেবেও। সংকলন তৈরির ভাবনাটাও এই সুবাদেই মাথায় আসে। গিরিধারী সরকার, যিনি ঘনাদাকে নিয়েই পিএইচডি করেছেন, তাঁর সঙ্গে আলোচনা করেই এই পুরো বিষয়টিকে বাস্তবায়িত করা হয়েছে।”

আরও পড়ুন
ফেলুদার শহরে শার্লক হোমসের ঠেক; ঢুঁ মারতেন সুকুমার সেন, প্রেমেন্দ্র মিত্র, নীরেন্দ্রনাথ, সমরেশ বসুরা

এই বিপুল কর্মকাণ্ডের সঙ্গে এবার জুড়তে চলেছে একটা বিশাল আর্কাইভ - ‘ঘনাদা ৭৫’। ঘনাদাকে নিয়ে যা লেখা হয়েছে, সেসব তো থাকছেই। পুরনো লেখাও যেমন আর্কাইভ করা হচ্ছে, তেমনই নতুন লেখাও যুক্ত হচ্ছে। সেইসঙ্গে থাকছে ঘনাদার বইয়ের প্রচ্ছদ, অঙ্কন-সহ আরও নানা জিনিস। এই উদ্যোগ নিয়ে ডঃ সোম ছাড়াও প্রহরের সঙ্গে কথা হয়েছে শুভেন্দু দাশমুন্সির সঙ্গে। শুভেন্দুবাবু এই কর্মকাণ্ডের অন্যতম উদ্যোক্তা এবং সংকলনের সম্পাদক। তিনি জানালেন, “আপাতত ই-বুক হিসেবে এই সংকলন বের করছি আমরা। শুধু লেখা নয়, ভিজুয়ালও থাকবে। সমস্ত রকমভাবে ঘনাদা-কে হাজির করার চেষ্টা করছি। আসলে ঘনাদা নিজেই একটা আস্ত ফ্র্যাঞ্চাইজি। যার কাছ থেকে ইতিহাস-বিজ্ঞান-পুরাণ তিনটে ব্যাপারই জানা যায়। কিন্তু বাঙালির কাছে বাকি দাদাদের মতো সেভাবে পৌঁছয়নি এই চরিত্রটি। পৌঁছেছে, কিন্তু একটা অংশের মধ্যে। কিন্তু আজকের সময় দাঁড়িয়ে দেখলে ঘনাদাই সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ মানুষ। 

সেজন্য কেবল লেখা বা ছবি, প্রচ্ছদ নয়; একটা ইতিহাসকেও দেখানোর চেষ্টায় আছি। অজিত গুপ্তের আঁকা ছবিটিই যে একমাত্র ‘ঘনাদা’র ছবি নয়; তার আগে এবং পরে অন্তত ৬০ জনের হাতেও তাঁর আরও রূপ ফুটে উঠেছে সেগুলোকেও আমরা এই সংকলনের মধ্যে আনার চেষ্টা করেছি। সেইসঙ্গে ওই গল্পগুলোর তথ্যকেও আনার চেষ্টা করেছি।”

প্রাথমিকভাবে ই-বুক হিসেবে তৈরি হয়েছে এই সংকলনটি। অল্প কয়েকদিনের মধ্যেই চলে আসবে আমাদের সামনে। হয়তো বই হিসেবেও পরবর্তীকালে আসতে পারে। সব মিলিয়ে, ঘনাদাকে নিয়ে আবারও উৎসাহ কলকাতার মধ্যে।    

আরও পড়ুন
প্রেমেন্দ্র মিত্রের উপহার দেওয়া বই সটান বিক্রি করে দিয়েছিলেন শিবরাম

Powered by Froala Editor

Latest News See More