আপনি হয়তো ভাববেন একটি থ্রিলার আপনার জন্যে অপেক্ষা করছে, কিন্তু... না। যে জঁর-কে হলিউড ঠেলতে ঠেলতে জনপ্রিয়তার তুঙ্গে নিয়ে গিয়েছে, সেই ‘মনস্তাত্ত্বিক হরর’-– ঠিক তাও নয়। ইন্দ্রাশিস আচার্য পরিচালিত ‘পার্সেল’ ছবিটিকে কিছু কারণে ‘অফ বিট’-ই বলা যায়।
লকডাউনের ফলে মাঝপথেই হল থেকে উঠে যেতে হয়েছিল, তারপর পুজোর আগে ফের মুক্তি পেয়েছে ‘পার্সেল’। এতদিন ঘরবন্দি থাকার পর এই ছবি দেখতে দেখতে একটা অদ্ভুত অস্বস্তি যেন ঘন হচ্ছিল। এমনিতেই ইন্দ্রাশিস চান তাঁর ছবি দর্শকদের নিছক মুগ্ধ নয়, অস্বস্তিতেও ফেলুক, বিব্রত করুক, নিবিড়-সঙ্গোপন নানা প্রশ্নের সামনে এনে দাঁড় করাক। এর আগে ‘বিলু রাক্ষস’ ও ‘পিউপা’-- দুটি ছবিতেই আতঙ্কের দমবন্ধ আবহাওয়া তৈরি করেছিলেন ইন্দ্রাশিস... যদিও তা আসলে ছিল নৈতিক-এর অভিজ্ঞান, এক গূঢ় বিপদ-সংকেত। প্রশ্ন, তর্ক ও গল্পের ছলে কোনও এক দার্শনিক মীমাংসাই যেন আগের ছবিদুটির উদ্দেশ্য। ...‘পার্সেল’ তাঁর তৃতীয় ছবি হিসেবে এই ধারাতেই পড়বে।
কোনো একদিন... ধরুন কেউ বেনামে ‘উপহার’ পাঠাল আপনাকে। প্রতিক্রিয়া কী হতে পারে? সুখ? আহ্লাদ? - অবশ্যই নয়। বরং উৎকণ্ঠা নামক বীজ কেউ বুনে দেবে, যা ফাটিয়ে বেরিয়ে আসে অবিশ্বাসের চারা। ...ধরুন, সেই ‘ভেট’ যদি হয় অদ্ভুত চরিত্রের (প্রথমে ফাঁকা অ্যালবাম, তারপর লুকিয়ে-তোলা আপনারই ফোটোগ্রাফ) এবং যদি আসতে থাকে ঘনঘন? ...নিশ্চিত হু-হু ক’রে বাড়বে আপনার রক্তচাপ। ঠাহর করতে চাইবেন – কেন আসছে এগুলো! কে আপনার সম্ভাব্য শত্রু? কারা হতে পারে!
‘পার্সেল’ ছবির নায়ক-নায়িকা, চিকিৎসক দম্পতিও এর ব্যতিক্রম হননি। নিজের অতীত সহসা এঁদের কাছে জরুরি অ্যালার্ম হয়ে উঠেছে এবং কবর খোঁড়াখুঁড়ি শুরু হয়ে গেছে।
বারেবারেই যেখানে তাঁরা এসে ঠেক খেয়েছেন তা হল একটি লুকোনো তেরচা আয়না – তাঁদেরই ‘বিবেক’। নষ্ট সম্পর্কের গ্লানি এরপর কুরে খাবে নায়িকাকে; নায়ককে নিজের ‘ডাবল ইমেজ’ বিব্রত ক্ষিপ্ত ক’রে তুলবে। - অসাড়, অপলক চোখে ছবিটি দেখে যাবে সাজানো ড্রয়িংরুম, হলুদ আলো, কলকাতার রাস্তা, হাসপাতালের ঝকঝকে ফ্লোর, পলেস্তারা-খসা অন্দর... সারি সারি মুখ, দেখতে দেখতে ফেটে বেরোবে চেপে-রাখা জিনিসগুলো - কেচ্ছা, আক্রোশ, অসহায়তা।
তাঁদের ‘পুরোনো আমি’-র সঙ্গে ‘নতুন আমি’-র বনিবনা হচ্ছে না, ক্রমে চিকিৎসক দম্পতি বুঝবেন। এই পেশা-পরিচয়ের মধ্যেও কীভাবে ‘অসুখ’ শব্দটি লুকোনো, এনক্রিপ্টেড রয়েছে!
আরও পড়ুন
‘দুধপিঠের গাছ’-এর প্রভাব, মোবাইলেই সিনেমা বানাচ্ছে আড়ংঘাটার ছেলেমেয়েরা
এবং কেউই তার বাইরে নয়। যখন সকলেই ব্যাধিগ্রস্ত; ছবির এক পুরুষ চরিত্র চেঁচিয়ে বলেন, ‘এখন কেউ কারও দিকে তাকায় না, কেউ না!’ এবং একটু থেমে, আরো জোরে, ‘ভাগাড়, আমরা একটা ভাগাড়ে আছি... বুঝলেন!’ কিংবা অন্যত্র, নায়িকার ভীত মুখ চেপে ধ’রে নারী চরিত্র হিসহিসিয়ে ওঠে, ‘আমি সব কিছু করতে পারি! সব কিছু!’ তখন এসব আর অচেনা, আলাদা ঠেকে না আপনার। এই নিভৃত মনস্টারকে আপনি জানেন।
আপনার, আমার, সকলের মধ্যেই ডাক্তার জেকিল ও শ্রীযুক্ত হাইডের লুকোচুরি চলছে। নিজের একাংশ নিয়ে এত অনিরাপদ বলেই আমাদের অপর অংশটি এভাবে গর্জন ও সত্য ভাষণ করে।
দম্পতির কন্যা (যে বালিকাটি এখনও ‘সুস্থ’ রয়েছে)... বেহালা শিখতে যায় একটি মিউজিক স্কুলে। আমাদের ছবি বারম্বার সেই রিহার্সাল দৃশ্যে ফিরে ফিরে আসবে। সমবেত অর্কেস্ট্রা শুনতে যেমন হয়; সেরকমই স্বর্গীয়, অসহ্য সুন্দর।
আরও পড়ুন
সিনেমার প্রযোজক প্রত্যেকেই; অর্থনৈতিক সংকটেও আশা হারাননি আড়ংঘাটার গ্রামবাসীরা
এই রিহার্সালের ঠিক পাশে হাসপাতালের ভাঙচুর দৃশ্যটি রাখুন। নায়ক (চিকিৎসক) হাল ছেড়ে দিয়েছেন, সহকর্মীরা সান্ত্বনার ভাষা খুঁজছেন... রোগীর মৃত্যু নিয়ে ক্রুদ্ধ জনতা লোহার গেট ঠেলছে, ফুলের টব আছড়ে ভাঙছে ল্যান্ডিং-এ। একজনের হাতে... বিগ ক্লোজ আপে দেখা যায় একটি আধলা ইট।
পীড়িত সমাজ যদি হয় একটি সিমফোনি তবে ব্যাক্তির নিজ নিজ পচন তার একেকটি ‘নোট’... যারা হাহাকারের মতো পাক খাবে, উঠবে নামবে, ছড়িয়ে পড়বে; এরই আনাচে কানাচে কুরিয়ার সার্ভিসের অচেনা লোক বারম্বার দিয়ে যাবে মোড়কে বাঁধা উপহার, চাইলেও ফেরানো যাবে না, সই ক’রে নিতে হবে প্রতিবার...। পালিয়ে রেহাই নেই; বেনামি পার্সেল সর্বত্র যায়, তার চলাচল অবাধ।
বালিকা কন্যাকে যে মহিলা স্কুলে নিয়ে যান, দেখভাল করেন, তিনি মুখ ফুটে বলেছিলেন বটে, ‘একটা সিসি টিভি যদি লাগান, (বাড়ি না থাকলেও) এই পার্সেল কে রেখে যাচ্ছে দরজায়, দেখা যেত...’ নায়ক দ্রুত উত্তেজিত হয়ে পড়েন, কথা আর এগোয় না।
আরও পড়ুন
এদেশের প্রথম দলিত ক্রিকেটার তিনি, ‘লগান’ সিনেমার কাছরা চরিত্রটির অনুপ্রেরণা
সিসিটিভি... যে লুকিয়ে দেখে, যে সব দেখতে পায়। - অবাক কাণ্ড! এই ছবিটিও লুকিয়ে দেখছে, দেখুন, কত দূর থেকে শটগুলি উঠছে, গাছের ফাঁক দিয়ে গাড়ি বেরিয়ে যাচ্ছে, গাড়ি ব্রেক কষছে, বিষণ্ণ নায়িকা হেঁটে আসছেন, নায়ক রাগত ভাবে কাকে ফোনে ধমকাচ্ছেন... আমাদের তখন খুব কাছে যাওয়ার অনুমতি নেই।
এবং দৃশ্যগুলিও আর স্থির নয়, তারা কাঁপছে; যখন অর্ধেক ‘মাস্ক’ করা থাকছে ক্যামেরা, কেউ আধখোলা চোখে নজর করছে যেন! ঘাসজমি কোপাচ্ছে দুই শ্রমিক, বাবা মেয়েকে গাছ চেনাচ্ছেন, মেয়ে জিজ্ঞেস করছে, ‘বাবা এই পাতাটার নাম কী?’ বাবা তাকে নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছেন... কার চোখ থেকে আমরা দেখছি এগুলো? সে কি হাওয়ায় মিশে থাকে, অন্য কোনও ডায়মেনশনে কুঁকড়ে যায় - মাস্টার শট যাকে ঠাহর করতে পারে না কখনোই!
‘পার্সেল’... যে ছবি চাইলে ছকে বাঁধা থ্রিলার বা হরর হতে পারত, কিন্তু হয় না; বরং একটু একটু ক’রে বাড়িয়ে যায় শীতল বিরক্তি। আপনার ভরকেন্দ্র ঈষৎ টাল খায়, নড়ে; প্রশ্নের শেকল খুলতে খুলতে আপনি দেখেন তা খুলছে তো খুলছে তো খুলছেই, এভাবে অসীম হয়ে যাচ্ছে... ‘মোড়ক খুললে কী পাব’, ‘কে পাঠাল এই পার্সেল’, ‘কিন্তু কেন? কী কারণ!’ – উত্তর দিতে চায় কি আদৌ এই ছবি?
ছবি - ‘পার্সেল’ (২০১৯)
কাহিনি ও পরিচালনা – ইন্দ্রাশিস আচার্য
অভিনয় – শাশ্বত চট্টোপাধ্যায়, ঋতুপর্ণা সেনগুপ্ত, শ্রীলা মজুমদার, প্রদীপ মুখোপাধ্যায়
Powered by Froala Editor