কাশ্মীরের লাদাখ সীমান্তকে ঘিরে অশান্ত হয়ে উঠেছে ভারত এবং চিনের সামরিক সম্পর্ক। ছবিটা আমাদের অনেকের কাছেই বেশ নতুন। যে প্রজন্ম আজকে তরুণ বা যুবক, তাঁরা বরাবর ভারত এবং পাকিস্তান বিরোধের কথা দেখতে এবং শুনতেই অভ্যস্ত। কিন্তু স্মৃতির সরণি বেয়ে হিমালয় আজও মনে রেখেছে ষাটের দশকের সেই রক্তক্ষয়ী দিনগুলোর কথা। কাশ্মীর নিয়ে ততদিনে পাকিস্তানের সঙ্গে বিরোধ শুরু হয়ে গিয়েছে। কিন্তু যুদ্ধের পরিস্থিতি প্রথম তৈরি হল চিনের সঙ্গে। অবশ্য সমস্যার সূত্রপাত কাশ্মীর নিয়ে নয়। চিনা বাহিনীর লক্ষ্য হল তিব্বত।
সদ্য জাপ সাম্রাজ্য থেকে মুক্ত হয়ে কি চিন নিজেই এক সাম্রাজ্যবাদী চেহারার মধ্যে ঢুকে গিয়েছিল? নাকি ভারত-চিন সীমান্ত সংঘর্ষের পিছনে ছিল অন্য কোনো কারণ? এই প্রশ্ন আপাতত অবান্তর। কিন্তু ভারতের অবস্থা যে সেদিন সত্যিই শোচনীয় হয়ে উঠেছিল, সেকথা বলাই বাহুল্য। একদিকে চিন আর অন্যদিকে পাকিস্তান - ঠিক শত্রুদের মাঝে বাসা নিয়ে থাকা! ওদিকে অবশ্য আমেরিকা এবং ব্রিটেন ভারতকে সাহায্যের নানারকম প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। কিন্তু তারা আছে পৃথিবীর সম্পূর্ণ বিপরীত প্রান্তে। প্রতিবেশীরাই যেখানে শত্রু, সেখানে এই দূরের বন্ধুরা আর কতটুকুই বা সাহায্য করতে পারেন? আবার পাকিস্তানে শুরুর দিকে প্রধানমন্ত্রী পদে ছিলেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহেরুর দীর্ঘদিনের রাজনীতির সঙ্গী মহম্মদ আলী জিন্নাহ্। ফলে বিরোধ যতই থাক, একটা সমঝোতায় আসার রাস্তা মোটামুটি সবসময় খোলা থাকত। কিন্তু পরবর্তীকালে সেই জায়গায় এলেন আইয়ুব খান। তিনি আবার কাউকেই তোয়াক্কা করেন না।
এমন সময়েই এল সেই চরম খবর। খবরটা প্রত্যাশিত হলেও সময়টা চমকে দিয়েছিল সকলকেই। সাধারণত যেকোনো সেনাবাহিনী অন্য বাহিনীকে আক্রমণ করে দিনের মধ্যভাগে। অথচ অরুণাচল প্রদেশ, আসাম অঞ্চলে যখন চিনের সেনাবাহিনী ঢুকে পড়ল, তখনও দিনের আলো ফুটতে বেশ কিছুটা বাকি। ২০ অক্টোবর, ১৯৬২ ভোর ৫টায় শুরু হয়ে গেল যুদ্ধ। লাদাখ সীমান্তে সূর্য ওঠে আরও খানিকটা দেরিতে। তাই সেখানে লড়াই শুরু হল সকাল ৭টা নাগাদ। এতদিন অবশ্য নানাভাবে সমঝোতার রাস্তাই খুঁজেছে নেহেরু সরকার। কিন্তু এবার তো আর পিছিয়ে আসা যায় না। আর ভারতের সেনাবাহিনীও পিছিয়ে আসতে রাজি নয়। তাই সামান্য কিছু অনুন্নত অস্ত্র, সামান্য সরঞ্জাম এবং অনেকটা আত্মশক্তিতে ভর করেই যুদ্ধ চালাতে থাকলেন এদেশের সেনাবাহিনী।
ভারত-চিন যুদ্ধ কিন্তু কিছুদিনের মধ্যেই আন্তর্জাতিক চেহারা নিয়ে নিয়েছিল। আমেরিকা বা ব্রিটেনের মতো শক্তি ভারতকে সাহায্য করতে এগিয়ে এসেছিল নিজেদের গরজেই। কিন্তু পাকিস্তানের ভূমিকা কী ছিল এই যুদ্ধে? আজ প্রায় বিস্মৃত হলেও পাকিস্তান সরকারের সেদিনের ভূমিকা এক অন্য নজির সৃষ্টি করেছিল নিঃসন্দেহে। চিনের আক্রমণ সামলাতে বিপর্যস্ত ভারতকে সেদিন দুদিক থেকে আক্রমণ করাই হয়তো পাকিস্তানের কাছে সবচেয়ে সহজ রাস্তা ছিল। পরিস্থিতির আনুকূল্যে সেদিন কাশ্মীর হস্তগত করা হয়তো পাকিস্তানের পক্ষে তেমন কঠিন ছিল না। আর সেইসঙ্গে দক্ষিণ এশিয়ায় একচেটিয়া আধিপত্য বিস্তার করার কাজটাও অনেক সহজ হয়ে যেত। কিন্তু কিছুদিন আগেও যে দুটো দেশ একসঙ্গে ছিল, একসঙ্গে লড়াই করেছে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে, সেইসব স্মৃতি কি এতই ক্ষণস্থায়ী? এত সহজে ভুলে যাওয়া যায় সব কিছু?
এর মধ্যেই একদিন ভারত-পাক সীমান্ত এলাকায় দেখা গেল রীতিমতো যুদ্ধের সাজে সেজে উঠেছে পাকিস্তানি বাহিনী। সিঁদুরে মেঘ দেখেই আঁতকে উঠেছিল প্রধানমন্ত্রী নেহেরুর বুক। সঙ্গে সঙ্গে ডাক পড়ল পাকিস্তানের ভারতীয় দূতাবাসের হাই কমিশনার রাজেশ্বর দয়ালের। খবর শুনে তিনি তো অবাক। এত বড়ো একটা ঘটনা ঘটতে চলল, অথচ তিনি কিছুই জানেন না? তবে কিছুদিন পরেই দেখা গেল, পরিস্থিতি একেবারেই তেমন নয়। বরং সম্পূর্ণ অপ্রত্যাশিত একটি চিঠি পেলেন পণ্ডিত নেহেরু। চিঠি পাঠিয়েছেন ইরানের শাহজি। তাতে তিনি জানিয়েছেন, আইয়ুব খানের কাছে এক পত্র পাঠিয়েছেন তিনি। আর তাতে স্পষ্ট নির্দেশ দিয়েছেন, পাকিস্তানের বাহিনী যেন লালফৌজের বিরুদ্ধে যুদ্ধে ভারতকে সহযোগিতা করে। মুহূর্তে পরিষ্কার হয়ে গেল পুরো বিষয়টা। ভারতকে বিপদে ফেলার জন্য নয়, বরং ভারতকে সাহায্য করতেই প্রস্তুতি নিচ্ছিল পাক বাহিনী। যদিও শেষ পর্যন্ত যুদ্ধে পাক বাহিনী অংশগ্রহণ করেনি। কিন্তু ভারতের দুর্বলতার সুযোগ নিতেও এগিয়ে আসেনি।
অবশ্য পাকিস্তানের এই সিদ্ধান্তের কারণ নিয়ে অনেক ধোঁয়াশা আছে। আমেরিকার কূটনীতিকদের কেউ কেউ দাবি করেন, মার্কিন সরকারের চাপেই পাকিস্তান শেষ পর্যন্ত ভারত আক্রমণের সিদ্ধান্ত থেকে বিরত থাকে। আবার কারোর কারোর মতে, পাকিস্তান ততদিনে ভাষা আন্দোলনের চাপে ততদিনে সরকার কোণঠাসা। এই পরিস্থিতিতে ভারত আক্রমণের সিদ্ধান্ত নিলে আবার জনমত বিরুদ্ধে চলে যেত। অবশ্য এইসব কারণের বাইরে গিয়ে নিছক দুই প্রতিবেশী দেশের আত্মিক যোগাযোগ থাকতে পারে না কি? অন্তত তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী লাল বাহাদুর শাস্ত্রীর বক্তব্যে উঠে এসেছিল সেই ইঙ্গিতই। সেদিন তিনি বলেছিলেন, এরপর যদি পাকিস্তান কাশ্মীর দাবি করে, তাহলেও ‘না’ বলা সম্ভব হবে না।
আরও পড়ুন
কলকাতার ‘দেবতা’ হয়ে উঠেছিলেন এই চিনা ব্যক্তি, টেরিটিবাজারে আজও রয়েছে মন্দির
তারপর কেটে গেছে অনেকগুলো বছর। ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধক্ষেত্রে মুখোমুখিও হয়েছে বারতিনেক। কিন্তু তা বলে ’৬২-র ঘটনা ভুলে যাওয়া মানে ইতিহাসকে অস্বীকার করা। তাই নয় কি?
Powered by Froala Editor