মনোবিদের চরিত্রে অভিনয় থেকে আত্মহত্যা - অলক্ষেই 'গল্প' বুনলেন আসিফ বাসরা?

টেবিলের একদিকে বসে রয়েছেন গল্পের মূল চরিত্র শ্রীকান্ত ও তাঁর স্ত্রী সুচিত্রা। হতাশাগ্রস্ত জীবন এবং মানসিক শান্তির খোঁজেই তাঁরা গেছেন মনোবিদের কাছে। হ্যাঁ, সদ্য-প্রকাশিত ওয়েব সিরিজ ‘দ্য ফ্যামিলি ম্যান’-এর দ্বিতীয় সিজনের কথাই হচ্ছে। এবার ক্যামেরা ঘুরল বিপরীতে। ফ্রেমে অস্বাভাবিকতার কিছুই নেই, তবুও মুহূর্তে গোটা শরীরে শিহরণ খেলে যেতে বাধ্য। কারণ, টেবিলে অন্যপ্রান্তে নোটবুক হাতে নিয়ে সাইকিয়াট্রিস্টের আসনে যিনি বসে আছেন, তিনি আর কেউ নন, প্রয়াত অভিনেতা আসিফ বাসরা।

গত নভেম্বরের কথা। মুম্বাইয়ের বাড়ি ছেড়ে কয়েকদিনের জন্য তিনি চলে গিয়েছিলেন হিমাচল প্রদেশে। ধর্মশালার কাছে একটি ভাড়া বাড়িতে গিয়ে উঠেছিলেন তিনি। তবে আর ফেরা হল না নিজের শহরে। বরং, সেই ভাড়া বাড়ির সিলিং থেকে তাঁর ঝুলন্ত দেহ উদ্ধার করেছিল পুলিশ। পুলিশের অনুমান ছিল মৃত্যুর কারণ আত্মহত্যাই। 

আশ্চর্যকর বিষয় হল, এই ঘটনার ঠিক কিছুদিন আগেই তিনি অভিনয় করেছিলেন ‘দ্য ফ্যামিলি ম্যান’ সিরিজটির জন্য। এবং সেটিই তাঁর অভিনীত সর্বশেষ সিরিজ। কিন্তু প্রশ্ন থেকে যায় এমন একটি চরিত্রে অভিনয় করার পরেও, এত সহজে কী করে জীবনের লড়াই ছেড়ে বেরিয়ে গেলেন তিনি? 

“যে ভূমিকাটির জন্য তিনি নির্বাচিত হয়েছেন, সেটাকে কতটা সফলভাবে ফুটিয়ে তুলতে পারেন, সেখানেই তো তাঁর পেশাদারিত্ব এবং অভিনয় ক্ষমতার স্ফূরণ। এবং আমরা দেখেছি, অনেক সময় একজন অভিনেতার ভেতরে যন্ত্রণা চলছে, আবেগ চলছে, অসুবিধা চলছে, তার কোনো ছাপ হয়তো তাঁর চরিত্রে পড়ছে না। সেখানেই তো একজন ব্যক্তিসত্তার ঊর্ধ্বে গিয়ে একটি চরিত্র হয়ে ওঠেন। বহুক্ষেত্রে আমরা এমন দেখে থাকি, একটা মানুষ যখন কোনো চরিত্রে অভিনয় করছেন, তখন তিনি সাইকিয়াট্রিস্টের ভূমিকায় রইলেন নাকি একজন মোটিভেশনাল স্পিকারের ভূমিকায় রইলেন, সেই সংলাপ তাঁর নিজের জীবনের চরম সংকটের মুহূর্তে একইভাবে মনে পড়বে এমনটা ধরে নেওয়া যায় না। সেখানে কিন্তু ব্যক্তি ও চরিত্রের একটা বিভাজন রেখা, একজন অভিনেতার জীবনে অবস্থান নিতেই পারে।” প্রহরকে বলছিলেন মনোবিদ অনুত্তমা বন্দ্যোপাধ্যায়। 

আরও পড়ুন
আবার মৃত্যুর ছায়া বলিউডে, গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মঘাতী অভিনেতা আসিফ বাসরা

কিন্তু আসিফ বাসরার চলে যাওয়ার এত এত দিন পরেও আজ রহস্যময় তাঁর মৃত্যুর কারণ। আর্থিক অসঙ্গতিই কি তাঁকে ঠেলে দিয়েছিল হতাশের অন্ধকারে? নিজের শহর ছেড়েই বা হিমাচলে চলে গেলেন কেন তিনি? এমন হাজারও প্রশ্ন উঠে আসে তাঁর রহস্যমৃত্যু নিয়ে। অনুত্তমা জানালেন, “সেখানে থাকাকালীন কতটা জীবন সম্পর্কে অর্থহীনতা তাঁকে গ্রাস করল, আর্থিক সংকটের পাশাপাশি অন্যকোনো বিপর্যয় তাঁর মনের মধ্যে উঁকি দিয়েছিল কিনা— এই সবের উত্তর এই মানুষটির সঙ্গেই চলে গেছে। কেউ যখন আত্মহত্যা করেন, তিনি কেন নিজেকে শেষ করলেন সেই প্রশ্নের উত্তর, বরাবর সেই মানুষটির সঙ্গেই চলে যায়। এক্ষেত্রেও উনি কী ভেবেছিলেন, এতদিন ধরে সেটা চলেছিল নাকি ওখানে যাওয়ার পর কিছু ঘটেছিল— এর উত্তর কিন্তু আমাদের কারোর কাছেই নেই।”

আরও পড়ুন
খুনের তত্ত্ব অলীক, আত্মহত্যাই করেছেন সুশান্ত - এইমসের রিপোর্টে বাড়ছে জনরোষ

আসিফ বাসরার এই ঘটনা মনে করিয়ে দেয় সুশান্ত সিং রাজপুতের কথা। ‘ছিছোরে’ কিংবা এমএসডি’র মতো সিনেমায় ইতিবাচক চরিত্রে অভিনয়ের পর তিনিও তো বেছে নিয়েছিলেন এই পথই। তাঁকে ঘিরে ফেলেছিল হতাশা নামের অন্ধকারটাই। আর অনুরাগীরা? বাসরা কিংবা সুশান্তের অভিনীত চরিত্ররা যে ভরসার আলো হয়েই বারবার ধরা দিয়েছে ভক্তদের কাছে। এমন ব্যক্তিত্বদের আত্মহত্যার ঘটনা অনুরাগীদের বিশ্বাসকেও কি টলিয়ে দেবে না কোথাও গিয়ে? “শুধু অভিনেতা কেন, একজন মানসিক স্বাস্থ্যকর্মীর জীবনেও অবসাদ, সংকট, হতাশা, এমনকি মৃত্যুর তাগিদও জন্মাতে পারে। তার মানে এই নয় যে যখন তিনি যেটা বলেছেন, তখন তিনি মিথ্যাচারণ করেছেন বা তখন সেটার প্রতি তিনি কমিটেড ছিলেন না। একটা নির্দিষ্ট পরিসরে একটা মানুষ যেভাবে কথা বলছেন বা যেভাবে উপস্থাপিত করছেন, তার দরুন তাঁর মধ্যে পরবর্তীকালে কোনো মৃত্যুচিন্তা বা নিজেকে শেষ করে দেওয়ার মতো অভিপ্রায় যে জন্মাবে না, তা হলফ করে বলা যায় না”, উত্তর দিলেন অনুত্তমা। 

আরও পড়ুন
বর্ণ-বিদ্বেষের বিরুদ্ধে সুশান্ত, ফিরিয়ে দিয়েছিলেন ১৫ কোটি টাকার বিজ্ঞাপনের প্রস্তাব

মনস্তত্ত্ব এক রহস্যময় ইতিবৃত্তই বটে। এমন তারকাদের এহেন প্রস্থান নিঃসন্দেহে এক স্তব্ধতার কাছেই পৌঁছে দেয় হয়তো দর্শকদের। তবুও তাঁদের চরিত্ররাই যেন বার বার শিখিয়ে যায়, ঘুরে দাঁড়ানোর লড়াইকেই। সেই ইতিবাচক অভিপ্রকাশটাকেই শুধু বেছে নেওয়ার দায় কি অনুরাগীদেরও থাকে না?

Powered by Froala Editor

Latest News See More