পাখিদের অজানা জগৎ চিনতে শিখিয়েছিলেন প্রথম বাঙালি পক্ষীবিদ অজয় হোম

তাঁর বাড়িতে ঢুকলেই দেখা যেত সার সার খাঁচা। সিঁড়ির পাশটা ভরে উঠত নানা জাতের পাখির কিচকিচ আওয়াজে। ঘরে ঢুকলেও হয়তো রবীন্দ্র রচনাবলীর পাশে থাকত একটা সুন্দর ময়না। পাখি, আর রবীন্দ্রনাথ— এই দুই নিয়েই তো বেঁচেছিলেন তিনি। অজয় হোম। বাংলার এখনকার প্রজন্ম সেরকম পরিচিত নয় এই নামের সঙ্গে। কিন্তু বাংলায় পাখি ও প্রকৃতিচর্চায় তিনিই অগ্রগণ্য। বেশ কিছু বছর হল চলে গেছে তাঁর জন্ম শতবর্ষ। তবুও বিস্তৃতির অতলে পড়ে রয়েছেন তিনি।

মেজর ফ্রাঙ্কলিন, স্যামুয়েল টিকল, অ্যালান অক্টেভিয়ান হিউম এবং পরবর্তীকালে সালিম আলির মতো প্রবাদপ্রতিম পক্ষীবিদদের সঙ্গে এক সারিতে নাম উচ্চারিত হয় তাঁর নাম। ‘বার্ডম্যান অফ বেঙ্গল’ নামে খ্যাত অজয় হোমের জন্ম ১৯১৩ সালে। ঠিক যে-বছর সাহিত্যে নোবেল পেলেন রবীন্দ্রনাথ। ছোট থেকেই পশু-পাখির প্রতি গভীর অনুরাগী ও কৌতূহলী ছিলেন অজয়। ছোটবেলায়, এক পরিচিত জনের কাছ থেকে উপহার পেয়েছিলেন একটি ময়না। ব্যস, তারপর থেকেই যাবতীয় কাজের শুরু। অবশ্য বাড়িতেও ছিল সেরকম পরিবেশ। মাও ভালবাসতেন পাখি। সেই ভালবাসাই সংক্রামিত হল অজয় হোমের মধ্যে। পরবর্তীতে তাঁর জীবনের দীর্ঘ চল্লিশ বছর তিনি পাখিদের নিয়ে গবেষণায় অতিবাহিত করেন। অবিভক্ত আসাম, বাংলা, বিশেষত সুন্দরবন অঞ্চলের বন্যপ্রকৃতির উপর তাঁর পড়াশোনা ছিল অসাধারণ। শুধুমাত্র পাখি নয়, অরণ্যপ্রকৃতি ও সেখানে বসবাসকারী উপজাতি সম্প্রদায়ের জীবন ও সমাজ সম্পর্কে তাঁর দীর্ঘ গবেষণা ছিল। মানুষ ও প্রকৃতি উভয় যে অবিচ্ছেদ্য এবং একে অন্যের ওপর নির্ভরশীল— এই ভাবনা তাঁর যাবতীয় কাজে দেখা গেছে। সাধারণ মানুষ, বিশেষ করে ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে বন্যপ্রাণী ও বনজ সম্পদের সংরক্ষণের প্রয়োজনীয়তা বোঝাতে সম্পূর্ণ নিজের উদ্যোগেই প্রকাশ করতেন ‘প্রকৃতি জ্ঞান’ নামে পত্রিকা।

বাংলা ভাষায় প্রকৃতিবিজ্ঞান এবং সেই নিয়ে কাজের ক্ষেত্রে অজয় হোমই পথিকৃৎ। বাংলার বহু অজানা, অচেনা পাখিকে তিনি চিনিয়েছেন আমাদের। তাদের প্রজাতিগত শ্রেণী বিভাজন, আকর্ষণীয় চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য তিনি বর্ণনা করেছেন সাবলীল লেখায়। তাঁর দীর্ঘ গবেষণা জীবনে পরিশ্রমের ফসল হল ‘বাংলার পাখি’ গ্রন্থটি, যার প্রচ্ছদ স্বয়ং সত্যজিৎ রায় উৎসাহী হয়ে তৈরি করেছিলেন। ‘বাংলার পাখি’ ও ‘চেনা–অচেনা পাখি’ — এই দুটি গ্রন্থের জন্য অজয় হোমকে ১৯৯৬ সালে মরণোত্তর রবীন্দ্র পুরস্কারে ভূষিত করা হয়।

বাংলা ভাষায় বিজ্ঞানসচেতনতা প্রসারে তাঁর উদ্যোগ ও গুরুত্বপূর্ণ অবদানের জন্য ১৯৮৭ সালে সায়েন্স এডুকেশন অফ বেঙ্গল তাঁকে বিশেষ সম্মানে ভূষিত করে। এছাড়াও বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ থেকে অজয় হোম পেয়েছেন অর্চনা পুরস্কার। তবে শুধু পাখি আর প্রকৃতি নয়, অজয় হোম ছিলেন নানা কাজে পারদর্শী। একটা সময় চুটিয়ে ক্রিকেট খেলেছেন। খেলেছেন ব্রিজ। রান্নাতেও ছিলেন পারদর্শী। এমনকি, গায়ক কৃষ্ণচন্দ্র দে'র ভাই প্রভাস দে'র সঙ্গে শুরু করেছিলেন ‘একতারা’ নামে একটি সঙ্গীতায়ন। জীবনের একটা বড় অংশ জুড়ে ছিলেন রবীন্দ্রনাথ। ‘আজকাল’ পত্রিকায় একসময় প্রকাশিত হত তাঁর নিয়মিত কলাম ‘প্রকৃতিপ্রেমীর চোখে’। স্বয়ং প্রশান্তচন্দ্র মহলানবিশের অনুরোধে তিনি ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিস্টিক্যাল ইন্সটিটিউটের লাইব্রেরির প্রধান লাইব্রেরিয়ানের পদে যোগ দেন। ১৯৭৩ সাল পর্যন্ত সেখানে দায়িত্ব পালন করেছিলেন অজয় হোম। বর্ণময় চরিত্র, বহুমুখী প্রতিভার এই মানুষটি ১৯৯২ সালে আমাদের ছেড়ে চলে যান। বাঙালির পাখি ও প্রকৃতি পড়াশোনার এক অধ্যায় যেন থেমে গিয়েছিল এক মুহূর্তে।

যত দিন যাচ্ছে, আমাদের চারপাশ থেকে পাখিরা কমে আসছে। এর জন্য যেমন দায়ী দূষণ, তেমনই দায়ী আমাদের অসচেতনতাও। কোথায় আর দেখা যায় সবুজ? তার বদলে চারিদিকে উঁচু উঁচু কংক্রিটের জঙ্গল। পাখিদের জায়গা নেই সেখানে। জায়গা নেই প্রকৃতিরও। যত উন্নত হচ্ছি আমরা, ততই দূরে সরে যাচ্ছে প্রকৃতি। আর এইসব সময়ই প্রয়োজন অজয় হোমের মতো মানুষদের। যারা এসে আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে যাবেন ভুলগুলো। কিন্তু তাঁকেও কি আমরা মনে রেখেছি? এবার প্রশ্ন করা হোক নিজেদের। নিজেদের সচেতনতাকে কাঠগড়ায় তোলা হোক। নয়তো আরও খারাপ দিন হয়তো অপেক্ষা করছে।

তথ্যসূত্রঃ
১)Ornithologist Extraordinary: "Note book" feature of "The Statesman", 6th May, 2013
২)“জন্মশতবর্ষে অজয় হোম”- সুমিত্রা চৌধুরী, জ্ঞান-ও-বিজ্ঞান, ১০ই মে, ২০১৩
৩)“শতবর্ষে পক্ষিপ্রেমী”- অশোক সেনগুপ্ত, আনন্দবাজার পত্রিকা, ১১ই অগাস্ট, ২০১২
8)“বাংলার পাখী”- অজয় হোম, দেজ পাবলিশিং

Powered by Froala Editor