তাঁর সাহিত্যে মৃত্যু এক চরিত্র: সাহিত্য ও জীবনদর্শনে অবধূত

“মৃত্যু জিনিসটা ভালো না মন্দ, তেতো না মিষ্টি, এ ধরনের প্রশ্নের শানানো জবাব হয়তো দেওয়া যায়। … কিন্তু মৃত্যু যে সত্যিই কি পদার্থ তা জানবার অতৃপ্ত তৃষ্ণার নিবৃত্তি কিছুতেই হবে না।… অজানা আর অনাস্বাদিত থাকে বলেই মৃত্যুকে আমাদের এত সমীহ করে চলা, এত পাশ কাটানোর চেষ্টা।” লিখেছেন কালিকানন্দ অবধূত, তাঁর ‘মরুতীর্থ হিংলাজ’ উপন্যাসে। ১৩৫৩ বঙ্গাব্দ— মানে ইংরেজি ১৯৪৬ সাল, ভারত প্রায় স্বাধীনতার দোরগোড়ায়।  পাকিস্তান তখনও ভারতের অন্তর্ভুক্ত। আষাঢ় মাসে করাচি থেকে রওনা হয়েছেন একদল হিংলাজ-তীর্থযাত্রী। কঠিন পথ— খালি পায়ে হেঁটে। মায়ের থান অবধি পৌঁছোতে পারবেন কি না যাত্রীরা, তাও অনিশ্চিত। প্রাণ থাকতে হিংলাজমাতা দর্শন করতে পারলেই নিজেকে ভাগ্যবান মনে হয়। প্রাকৃতিক দুর্যোগ, খাবার-জলের অভাব, সে ধকল নিতে না পেরে মৃত্যু, উপরন্তু পথে ডাকাত-দুষ্কৃতিদের হাতে প্রাণ যাওয়ার ভয়। এই তীর্থযাত্রা চেনায় মৃত্যুকে, উপলব্ধি করায় খুব কাছ থেকে।     

তাঁর সাহিত্যে মৃত্যু হয়ে ওঠে এক চরিত্র। সাহিত্য, সমাজ, আইন, বিজ্ঞানের ঊর্ধ্বে তিনি তৈরি করেছিলেন নিজস্ব এক ধারা। বাংলা সাহিত্য জেনেছিল তন্ত্রসাধনার সাহিত্যদর্শন, তাঁর বলিষ্ঠ লেখনীতে। তিনি হলেন অবধূত— কালিকানন্দ অবধূত, যাঁর আসল নাম দুলালচন্দ্র মুখোপাধ্যায়। স্থানীয়রা তাঁকে ‘স্বামীজি’ বলতেন। বাংলা সাহিত্যের  জগত থেকে প্রায় ফিকে হয়ে যাওয়া এক নাম। হুগলি জেলার চুঁচুড়া শহরের জোড়াঘাট লাগোয়া নীলচে সবুজ বাড়ি। অবধূত নাম দিয়েছিলেন ‘রুদ্রচণ্ডীর মঠ’। তৎকালীন কোস্টাল আইনে বলা ছিল, নদীর ধার থেকে দশ  ফুটের মধ্যে কোনও বাড়িঘর করা যাবে না। এই আইন  জানা ছিল না ‘স্বামীজি’র। তিনি চেয়েছিলেন নদীর পাড়ে ঘর বাঁধতে। এ স্থানে জমিটি নদীর পাড় থেকে উঁচু ঢিবির মতো হয়ে গেছে, খানিক কচ্ছপের পিঠের মতো। যা তন্ত্রসাধনার উপযুক্ত। অজান্তেই আইনভঙ্গ হল। মামলা হল তাঁর বিরুদ্ধে। পারিবারিক সূত্রে জানা যায়, সরকারের তরফে এই মামলা আর এগিয়ে নিয়ে যাওয়া হল না। নাতি তারাশঙ্কর মুখোপাধ্যায়ের কথায় পরবর্তীকালে অবধূত বাড়িটি সম্পূর্ণ করেছিলেন ‘মরুতীর্থ হিংলাজ’ বইটি বিক্রির টাকা থেকে। তাই স্থানীয়দের কাছে ‘মরুতীর্থ হিংলাজ’ নামেই পরিচিত। ইতিহাসের পাতায় হয়তো স্থান পায় না এই জোড়াঘাট, কিন্তু ঐতিহাসিক ঐতিহ্য লেখা এই ঘাটে। ঘাটের একদিকে ‘বন্দে মাতরম্ ভবন’। সাহিত্য সম্রাট বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় যখন ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে চুঁচুড়ায় কর্মরত,  তখন এই বাড়িটিতে থাকতেন। এখানে আনন্দমঠ উপন্যাসের কিছু অংশ লেখা হয় বলে জানা যায়। জোড়াঘাটের আর এক পাশে ‘বন্দে মাতরম্’ ভবনের উল্টোদিকে ‘মরুতীর্থ হিংলাজ’। বাড়িটি প্রায় নদীর জল ছুঁইছুঁই। অবধূত তাঁর শেষ জীবনে, ১৯৬৫ সালের পর থেকে যে ঘরটিতে থাকতেন সেই ঘরের জানালা দিয়ে দেখা যায়, হুগলি নদীর নীল জল। স্থানীয়রা বলেন, এখানে দু’টি ঘাট জোড়া লাগানো ছিল, তাই নাম হয়েছে জোড়াঘাট। আজ দু’টি ঘাটের জোড়বন্ধন চোখে পড়ে না, কিন্তু জোড়বন্ধন রয়েছে দুটি ভবনের— সাহিত্য সম্রাটের ‘বন্দে মাতরম্ ভবন’ আর অবধূতের ‘রুদ্রচন্ডীর মঠ’।

এক জীবনে বিপ্লবী, সন্ন্যাসী, তন্ত্রসাধক, আবার সাহিত্যিক— বাঙালির বিস্ময় তিনি। বিপ্লবী দুলালচন্দ্র ইংরেজ পুলিশের চোখ ফাঁকি দিয়ে উজ্জয়িনী পৌঁছান। সেখানে মহাকাল মন্দিরে অবধূত সাধু সম্প্রদায়ের (দশনামী সম্প্রদায়) কাছে দীক্ষিত হন। অবধূত সম্প্রদায়ের সাধুরা ছিলেন গৃহী সন্ন্যাসী। সন্ন্যাসজীবনে তিনি নাম নেন কালিকানন্দ অবধূত। সেই  জীবনে তাঁর সঙ্গিনী হন ভৈরবী মা (সরোজিনী দেবী, দ্বিতীয় স্ত্রী)। সন্ন্যাসী অবধূত শুরু করেন পরিব্রাজকের জীবন। খালি পায়ে পরিভ্রমণ করেন সারা ভারতের বিভিন্ন তীর্থক্ষেত্র। তাঁর পরিবারের সদস্যরা বলেন, এমন কোনও তীর্থক্ষেত্র নেই যা তিনি পরিভ্রমণ করেননি। পরিব্রাজকের জীবন থেকে শুরু হয়  তাঁর সাহিত্যচর্চা— ভ্রমণকাহিনি আর অভিজ্ঞতা মিলিয়ে। 

অবধূতের জীবন, বিপ্লবী সত্তা, সাহিত্য নিয়ে অনেকেই আলোকপাত করেছেন। এই নিবন্ধে তাই সেদিকে না গিয়ে একটু ভিন্ন দিকের খোঁজ। পুত্রবধূ সূচনা মুখোপাধ্যায়ের স্মৃতিচারণায় উঠে আসে তাঁর জীবনের এক বিশেষ ঘটনা। ‘মরুতীর্থ হিংলাজ’ উপন্যাসে জীবনের অনিশ্চয়তার ভয়াবহ সত্য ফুটে ওঠে, যখন বারবার তীর্থযাত্রীরা সেই মরুপ্রান্তরে সম্মুখীন হন দুষ্কৃতিদের। সেই প্রসঙ্গে তিনি লিখেছেন, “পাহাড়ের নীচে অন্ধকারে আত্মগোপন করে মৃত্যু আমাদের অপেক্ষায় হাঁ করে বসেছিল। নিরুদ্বিগ্ন চিত্তে আমরা আসছি— সোজা সেই হাঁ করা মুখের মধ্যে প্রবেশ করতে।  …কিন্তু বাদ সাধল… এই বৃদ্ধ পিতা আর তার নির্ভীক যুবক পুত্র। …মৃত্যুকে মৃত্যু উপহার দিলে।”

১৯৭৩ সাল, এপ্রিল মাস। পুত্রবধূ সূচনা মুখোপাধ্যায় তখন আটমাসের অন্তঃসত্ত্বা। সূচনাদেবীর বাড়ি বেথুয়াডহরিতে। এই অবস্থায় তাঁর বড়দি তাঁকে বাড়ি নিয়ে যান। প্রসবের সময় এগিয়ে আসে। স্থানীয় স্বাস্থ্যকেন্দ্রে  নিয়ে যাওয়া হয় সূচনাদেবীকে। স্বাস্থ্যকেন্দ্র বলে, তাঁর গর্ভস্থ সন্তানের কোনও সাড়া পাওয়া যাচ্ছে না। তাই তাঁকে পাঠানো হয় কৃষ্ণনগরে। কৃষ্ণনগর হাসপাতালে তখন শয্যা খালি নেই। মেঝেতেই থাকতে হবে। তাই তাঁকে আবার নিয়ে যাওয়া হল মাতৃসদনে। কিন্তু তাতেও লাভ হল না। সূচনাদেবীর রক্তাল্পতার ধাত, অথচ মাতৃসদনে রক্ত নেই। সেইসময় তাঁর খোঁজ নেন অবধূত। সূচনা দেবীর স্বামী (অবধূতের প্রথম পক্ষের ও একমাত্র সন্তান) নিয়ে আসেন চুঁচুড়া হাসপাতালে। প্রায় দশদিন ধরে ঘুরতে থাকেন এ হাসপাতাল থেকে ও হাসপাতাল। চুঁচুড়া হাসপাতালেও একই কথা— গর্ভস্থ সন্তান নড়ছে না। তার সাড়া পাওয়া যাচ্ছে না। ডাক্তাররা বলেন, ‘সিজার’ করতে হবে। দু’বোতল ‘স্যালাইন’ দেওয়া হল সূচনাদেবীকে। প্রায় যমে-মানুষে টানাটানি। এসময় অবধূত খুঁজে পান, সূচনাদেবীর কুণ্ডলীতে লেখা— সন্তান প্রসব করতে গিয়ে মা ও সন্তান দুজনেরই ‘মৃত্যুযোগ’। অবধূত তখন তারাপীঠে সাধনা করতেন। তিনি স্থির করেন, পুত্রবধূর সন্তান হবে স্বাভাবিকভাবেই, কোনও বিপর্যয় ছাড়াই। যজ্ঞে বসলেন অবধূত। বেলকাঁটা দিয়ে নিজের বুক চিরলেন। রক্ত দিয়ে আহুতি দেন একশো আটটা বেলপাতা। ওদিকে হাসপাতাল থেকে সূচনাদেবীর স্বামীকে বলা হল সকাল ন'টা থেকে সাড়ে নটার মধ্যে চলে আসতে। সাড়ে ন’টার দিকে তাঁকে অপারেশন থিয়েটারে নিয়ে যাওয়া হবে। বাড়িতে সারারাত জেগে যজ্ঞ করতে থাকেন অবধূত। ভোর তিনটে থেকে সূচনাদেবীর প্রসব যন্ত্রণা ওঠে। ভোর পাঁচটায় জন্ম হয় তাঁর প্রথম সন্তান তারাশঙ্কর মুখোপাধ্যায়ের। ১৯৭৩ সালের ২৭ এপ্রিল। 

জীবন ও মৃত্যুর ‘শক্তি’র আদি-অনন্ত প্রতিযোগিতার সাক্ষী অবধূতের সৃষ্টি— ‘মরুতীর্থ হিংলাজ’। তাঁর পার্থিব জীবন  এভাবেই মিলে যায় হাতে গড়া সাহিত্যের সঙ্গে। মৃত্যুকে মৃত্যু নয়, বরং জীবন উপহার দিয়েছেন তিনি। অথচ সেই মানুষ চলে যান মাত্র ৬৬ বছর বয়সে, ১৯৭৮ সালের ১৩ এপ্রিল। বাংলা নববর্ষের দু’দিন আগে। তার মাস কয়েক আগেই চলে গিয়েছেন তাঁর ভৈরবী। মাত্রাতিরিক্ত মাদকসেবন তাঁকে ধীরে ধীরে ঠেলে দেয় মৃত্যুগহ্বরে। জীবন সায়ান্হে এসে মৃত্যুকে অনুভব করেছেন। তিনি মারা যাওয়ার কয়েকদিন আগে থেকেই পুত্রবধূকে বলতেন, “আমি যাব। একদম একা যাব।” যে এপ্রিলে তিনি প্রাণ বাঁচিয়েছিলেন পুত্রবধূ ও নাতির, সেই এপ্রিলেই তিনি নিজে চলে গেলেন ‘অজানা অনাস্বাদিতপূর্ব মৃত্যুর জগতে’। 

তাঁর কাহিনি অলৌকিক ঠেকতে পারে। নিছক কুসংস্কারাচ্ছন্ন গল্পগাথা। কিন্তু তিনিও তো মৃত্যুর সেই অন্ধকার জগতটার মতোই দুর্ভেদ্য। তাই তাঁকে নিয়ে দ্বিমত ও তর্কবিতর্কের শেষ নেই। তবু বিশ্বাস করতে ক্ষতি কি? ‘বিশ্বাসে মিলায় বস্তু, তর্কে বহুদূর।’

(নিবন্ধটি অবধূতের পুত্রবধূ সূচনা মুখোপাধ্যায়ের স্মৃতিচারণার ভিত্তিতে লেখা। ২০২৪ সালে ২২ ফেব্রুয়ারি সূচনা দেবীও পরলোকগমন করেন।)

তথ্যসূত্র ও ঋণস্বীকার:

১) অবধূতমরুতীর্থ হিংলাজ, মিত্র ও ঘোষ, কলকাতা, ১৩৬২ বঙ্গাব্দ।
 ২) সাক্ষাৎকার: তারাশঙ্কর মুখোপাধ্যায়, অবধূতের পৌত্র, স্থান- চুঁচুড়া হুগলি (জুলাই-সেপ্টেম্বর, ২০২৩)
 ৩) স্মৃতিচারণা: শ্রীমতী সূচনা মুখোপাধ্যায়, অবধূতের পুত্রবধূ, স্থান- চুঁচুড়া হুগলি (৮ জুলাই ২০২৩)। 

Powered by Froala Editor

More From Author See More

Latest News See More