৬১-তে মৃণালের ‘পুনশ্চ’: লিঙ্গসাম্যের বহমানতা নাকি সোনার পাথরবাটি?

“এতদিন তো তোমরাই অহংকার করে এসেছ, আজ আমাদের অহংকার একটু সহ্য করতে পারবে না?”

এই তো! এই তো! চেঁচিয়ে উঠেছি দেখে বেশ ঘাবড়ে গিয়েছিল মা! স্বাভাবিক ব্যাপার! অমন দড়াম করে চিৎকার করে উঠলে যে-কেউ ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যাবে! কোনোক্রমে নিজেকে সামলে আবার গুছিয়ে বসতে বসতেই ‘আমি যাই’ বলে, আড়চোখ ছবিকে মেপে নিয়ে সুবোধের ঘর থেকে বেরিয়ে গেল বাসু। আসলে এক একটা সিনেমা নিয়ে বসলে আমার এমনটা মাঝেমাঝে হয়। এই যেমন ১৯৬১ সালে মুক্তি পাওয়া এবং তারপর শ্রেষ্ঠ আঞ্চলিক ভাষার ছবি হিসাবে জাতীয় পুরস্কার জিতে আসা মৃণাল সেনের (Mrinal Sen) ‘পুনশ্চ’ (Punascha) সিনেমাটা বহুবছর পর আবার দেখতে দেখতে মনে হচ্ছিল, বাসন্তীর মুখে এই ডায়ালগটার জন্য আমি বোধহয় বিগত কয়েক জন্ম অপেক্ষা করে ছিলাম। ১৯৬১ থেকে ২০২২— মাঝখানে কেটে গেল ৬০টা বছর— ভাবতে অবাক লাগে পুনশ্চর মতো একটা ফিল্ম বঙ্গজীবনে এখনও সমান প্রাসঙ্গিক। এখন প্রশ্ন হল, এই প্রতিভাসকে আমরা কীভাবে নেব? এ কি এক শিল্পীর অনন্ত দূরদর্শিতা, নাকি বঙ্গসমাজের অঙ্গ হিসাবে আমাদের নিতান্ত ব্যর্থতা?

সে-প্রশ্নে যাব, তবে তার আগে ছবিটার দু-একটা ব্যাপারে পুনরায় আলোকপাত আবশ্যক। ষাট বছরের বহমানতায় যে চলচ্চিত্র বাঙালি মনকে বারবার ছুঁয়ে গেছে তার ন্যারেটিভে ঢোকার বিশেষ প্রয়োজনীয়তা না থাকলেও, মৃণাল সেনের নিউট্রালিটি এবং ইন্টারটেক্সচুয়ালিটি যে আমাদের এখনও সমানভাবে প্রভাবিত করে, এ-কথা অবশ্যই অনস্বীকার্য। প্রথমত এক নিবিড় শৃঙ্খলাবদ্ধ নিউ ওয়েভ মিডিয়া আর্টিস্টের ধারায় মৃণাল তার লেন্সের মাধমে প্রত্যেকটি চরিত্রকে কেবলই নিরীক্ষণ করে চলেন। ফিকশন ছবিতে পরিচালকের হাতে যে ক্ষমতা থাকে, সেই ক্ষমতার অপপ্রয়োগ আমরা কখনই ’৬১-র পরিচালক মৃণাল সেনকে করতে দেখি না। গল্পের পরত খুলতে খুলতে পরিচালক কোথায় যেন এক নিখাদ বস্তুনিষ্ঠ শিল্পী এবং ডায়ালেক্টিক্সের নন-জাজমন্টাল ছাত্র হয়ে ওঠেন। মৃণালীয় দর্শনের এই নির্দিষ্ট ধারা তার পরবর্তী প্রায় সমস্ত ছবিতেই যে আরো পরিপক্ক হয়েছে, সে-কথা বলার অপেক্ষা রাখে না। এছাড়া, তার নিউওয়েভ দর্শনের ইন্টারটেক্সটচুয়ালিটির নিদর্শন গল্পের মধ্যেকার একাধিক প্রাবন্ধিক বাঁকে মুহুর্মুহু ধরা পড়ে যায়, তা সে প্রিন্সেপ ঘাটের নির্মাণাধীন চেহারাই হোক বা মধ্যপ্রদেশের কয়লাখনিকে ভিত্তি করে গড়ে ওঠা তৎকালীন ভারতবর্ষের উৎপাদনশীলতার নিদর্শন। কাজেই সে দিক থেকে তার অন্যান্য ছায়াছবির মতো ‘পুনশ্চ’ অবশ্যই কিছু কিছু ক্ষেত্রে ইতিহাসের স্বাক্ষর। কিন্তু তেমন ঐতিহাসিক আর্কাইভিং দেখতে হলে মৃণালের পুনশ্চ দেখার প্রয়োজন পড়ে না, তার জন্য রয়েছে ঋত্বিকের অযান্ত্রিক বা সত্যজিতের অভিযান! আমরা তাই আবারও ফিরে যাই প্রাসঙ্গিকতার প্রশ্নে। ঠিক কোথায় পুনশ্চ সৌভাগ্য বা দুর্ভাগ্যবশত ভাবে এখনও প্রাসঙ্গিক? একটা ছোট্টো জাম্পকাটের সাহায্য নেওয়া যাক—

বাসন্তী (পুনশ্চ-এর নায়িকা) স্টেনোটাইপিস্টের চাকরিটা নিয়েই ফেলল। একটা স্বচ্ছল দাম্পত্য তৈরির জন্য দুজনেরই উপার্জন প্রয়োজন, প্রেমিক তথা হবু বরের এমন আবদার ফেলতে পারেনি বাসু। তবে মুখে এ কথা বললেও বাসু জানে, বাবার রিটায়ারমেন্ট সামনে, দাদার কাজ নেই, চাকরিটা তাকে নিতেই হত। এগিয়ে চলা গল্পের প্রথম ধাপে সিলভার স্ক্রিনে ভেসে ওঠা বাসুর তৃপ্ত মুখ বাবা ও প্রেমিক উভয়ের দিকেই দামি ব্র্যান্ডের সিগারেট উপহার হিসাবে এগিয়ে দিতে চাইলেও, বাবাকে বলতে শুনি, ‘মেয়ে না হয়ে যদি ছেলে হয়ে জন্মাত, শেষ জীবনটা তবে একটু শান্তিতে কাটাতে পারতাম!’ এই ঘটনাকে আমাদের মন প্রজন্ম ব্যবধানের সমস্যা বলে উড়িয়ে দিতে চাইলেও, গল্পের আড় ভাঙতে ভাঙতে পরিচালক মৃণাল তথাকথিত চাকু্রিজীবী যুবসমাজের মনের গভীরে গেড়ে বসা পিতৃতন্ত্রের অন্ধকার দিকগুলোকেও বহিরঙ্গ প্রগতিশীলতার প্রলেপ ছিড়ে উলঙ্গ করে ফেলেন আমাদের চোখের সামনে। 

আরও পড়ুন
বন্ধ্যা সময় ও মৃণাল সেনের চলচ্চিত্র

জাম্পকাট: ২০২২

আরও পড়ুন
কানের মঞ্চে জন্মদিন পালন মৃণালের, প্রতিবছর দেখানো হত একটি করে ছবি!

ক (যিনি পুরুষ) বললেন, ‘হাজার হোক, সমাজের নিয়মকানুন তো মেনে চলতে হবে। যা দুর্ভোগ হবার তা হয়ে গেছে এবার গুছিয়ে নেওয়ার সময়; মেয়ে হয়ে জন্মেছে যখন একজন অভিভাবক তো সবসময়ই প্রয়োজন।’ সম্মতি সূচক মাথা নাড়লেন খ ও গ, উভয়ই মহিলা, ভাবটা এমন এই একটা কথার মত কথা বৈকি। মুচকি হেসে, এ কথায় যে মনে মনে বেশ খুশিই হলেন তিনি, তা বুঝিয়ে দিলেন ঘ! ঘ মানে, যার অভিভাবক না হলেই নয় বলে স্থির করেছেন ক, তিনি। আমি বুঝি; ঘ-এর উপার্জিত টাকায় এই যে মাঝেমধ্যে ঘুরে বেড়ানো, খাওয়া দাওয়া, আনন্দ ফূর্তি তা মনে মনে কোথাও ক-কে দারুণ তৃপ্ত করে। রাস্তায় হাটতে হাটতে ঘ গর্ব করে চাকরি, উপার্জন, ইত্যাদির বড়াই করলেও কোথাও যেন পরিচিত সামাজিক-নিয়ম পরিচালিত কাঠামোয় এই নবতরঙ্গের ফিট না হতে পারাটা তার অভ্যন্তরীণ দোলাচলতাকে উস্কে দেয়। মনের নিজস্ব ও স্বতন্ত্র প্রবৃত্তিগুলোকে ছাপিয়ে পরিকাঠামোর গুরুত্ব প্রাথমিক হয়ে ওঠে। জীবনের সায়াহ্নে এসে পড়ে পাওয়া দুই আনা আনন্দকে গোড়া থেকে উপড়ে ক বলে, ‘মেয়ের টাকায় বেড়াতে হচ্ছে শেষেমেষ!’

আরও পড়ুন
ঠাঁই হল না কলকাতায়, মৃণাল সেনের শেষ স্মৃতিচিহ্ন শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ে

এ তো গেল এক সামান্য সমাপতন, ২০২২ সালের বঙ্গ সমাজে এবং কেবলমাত্র আমার ব্যক্তিজীবনের আঙিনায় পুনশ্চের নানান দৃশ্যের এমন সাযুজ্যের আসর বসালে রাত কাবার হয়ে যেতে পারে; আমি নিশ্চিত আমাদের সকলের জীবনেই এমন উদাহরণ মুহুর্মুহু রয়েছে; দুর্ভাগ্যবধত ৬১ বছর বয়সি ‘পুনশ্চ’-এর বারংবার নিরীক্ষণ সত্ত্বেও! কাজেই সঞ্জয়দা যখন লেখেন;

‘…মৃণাল সেনের অন্যতম পথ প্রদর্শক, ইতালীয় নববাস্তববাদের দ্রোণাচার্য, সেজারে জাবাত্তিনি যেমন তাঁর ইস্তেহারে বঙ্কিম হরফে তিনবার লেখেন ‘টুডে, টুডে, টুডে’, মৃণাল এই ঘিঞ্জি অস্বাস্থ্যকর শহরের নিম্নমধ্যবিত্ত ভাড়াটে বাড়ির থেকেই তেমন সাক্ষাৎকারে ‘আজকের দিন’ বিষয়ে প্রশ্ন তোলেন।’

আমি ভাবি মৃণালবাবু কি তাঁর ঘোর দুঃস্বপ্নেও ভেবেছিলেন যে সেই 'আজ'-এর পরীক্ষায় বসে তথাকথিত লিবারাল বাঙালি এই অর্ধশতাব্দীকালীন বিবর্তনের পরেও পাশ নম্বরটুকুও জোটাতে পারবে না? উপরন্তু লিঙ্গসাম্যে যুযুধান এক কবিকে (মল্লিকা সেনগুপ্ত) লিখতে হবে

“আপনি বলুন মার্ক্স, মেয়েরা কি বিপ্লবের সেবাদাসী হবে?”

ভাবলেন বুঝি আমার কথাটি ফুরাল? দাঁড়ান, এই গোলমাল বাধল বলে! লিবারাল বামপন্থীরা গাল দেবেন, বলবেন এ কবিতার কোনো মানেই নেই; মার্ক্স এ-কথা বলেনইনি! বিশ্বাস করুন, মার্ক্স যে এ-কথা বলেননি মল্লিকা এবং মৃণাল উভয়ই জানতেন। বুঝি না আমরা, তাই রাস্তাঘাটে বামপন্থার নামতা আওড়ে বাড়ি পৌছে আবারও নিজের মেয়ে বৌদের নিজেদেরই ‘নানান’ প্রয়োজনে দরকারে বাইরে পাঠাই, দরকারে বিছানায়-রান্নাঘরে বেঁধে রাখি! কাজেই মূর্খের স্বর্গযাপনে ব্যস্ত আমাদের কাছে এই ৫০ বছর পরেও সে-উত্তর না থাকলে স্বয়ং মার্ক্সের কাছে শুধানো ছাড়া আর উপায় কী থাকে বলুন? 

ও হ্যাঁ, শেষ করার আগে আরেকবার মৃণালের ইন্টারটেক্সটচুয়ালিটিতে ফিরে আসার প্রয়োজন আছে! ‘পুনশ্চ’ সিনেমায় বাসুর বাবা এবং প্রেমিক যেমন রয়েছেন তেমনই মা আছেন আর রয়েছেন বৌদি; যিনি নিজের আর্থিক প্রয়োজনে বাসুর কাছেই ইংরেজি শিখতে চান আবার শান্তির সংসার রক্ষা হলে তাকেই আবার ‘মেয়েমানুষের মাথা পেতে মানিয়ে নেওয়ার’ শলা-পরামর্শ দিতেও ভোলেন না। কাজেই এতসবের মাঝে, মানে মার্ক্সের থিসিস-অ্যান্টি থিসিস, মৃণালের ডায়ালেক্টিক্সের মাঝে যেন সিমন দে বাভোয়ার ‘হাফ এ্যাকমপ্লিস হাফ ভিক্টিম’ তত্ত্বটা বাদ না পড়ে যায় সেদিকেও নজর রাখার প্রভূত প্রয়োজন রয়েছে অবশ্যই! আর প্রয়োজন ভাবা, রামমোহন ও বিদ্যাসাগর মশাই নেহাৎ অকারণে আমাদের পেছনে তাঁদের শ্রম ও মূল্যবান সময় নষ্ট করলেন না তো?

(মতামত লেখকের ব্যক্তিগত)

Powered by Froala Editor

More From Author See More