আটের দশকের কথা। একের পর বন্যায় বিধ্বস্ত হয়ে গেছিল মহারাষ্ট্রের হিভরে বাজার (Hiware Bazar) গ্রামের জনজীবন। আবার কখনও তীব্র খরায় ফসলের মুখ দেখতে পেতেন না চাষিরা। নিত্য অভাব থেকে বাঁচার জন্য গ্রামবাসীরা পাড়ি জমাচ্ছিলেন রাজ্যের অন্যান্য প্রান্তে। পোপটরাও বাগুজি পাওয়ার নামের এক ব্যক্তিও ছিলেন সেই দলে। হিভরে বাজার ছেড়ে এক দশক কাটান আহমেদনগরে। ১৯৮৯ সালে ফিরে এলেন তিনি। সঙ্গে নিয়ে এলেন একগুচ্ছ পরিকল্পনা। দ্রুত বদলে যেতে থাকে হিভরে বাজারের মানুষের জীবনযাত্রা, অর্থনীতি। আজ এই গ্রাম পরিচিতি পেয়েছে ভারতের অন্যতম ‘ধনী’ গ্রাম হিসেবে।
গ্রামের জনসংখ্যা মাত্র ১৩০০। মোট পরিবার সংখ্যা ৩০০-র থেকে সামান্য বেশি। অথচ, তিন দশক আগেও পরিস্থিতি ছিল সম্পূর্ণ অন্যরকম। জলের অভাবে বন্ধ হয়ে যাচ্ছিল চাষাবাদ। ভূগর্ভস্থ জল নেমে গেছিল একশো ফুট নিচে। সর্বত্র যেন এক আগাম বিপদের আশঙ্কা। পোপটরাও ছিলেন সেই গ্রামের একমাত্র স্নাতকোত্তর স্তরের পড়াশোনা করা ব্যক্তি। গ্রামে ফিরে পঞ্চায়েত নির্বাচনে দাঁড়ান তিনি। প্রতিদ্বন্দ্বীহীন লড়াইয়ে হয়ে উঠলেন ‘সরপঞ্জ’। পাঁচটা পরিকল্পনা নিয়ে শুরু হয় তাঁর পথচলা। গ্রামের উন্নতির জন্য সকলে মিলে ‘শ্রমদান’, পশুচারণ ও গাছ কাটা বন্ধ, বেআইনি মদের ভাঁটি উচ্ছেদ ও পরিবার পরিকল্পনা।
একই সঙ্গে সরকার কাছে ক্রমাগত আবেদন করতে থাকেন ঋণপ্রদানের জন্য। সে অর্থও মিলল। এদিকে বৃষ্টির জল সংরক্ষণ ও জলাশয়ের সংস্কারের মাধ্যমে পর্যাপ্ত জল পাওয়া গেল চাষাবাদের জন্য। পশুচারণ ও বৃক্ষচ্ছেদন বন্ধ হওয়ায় ইতিমধ্যেই সবুজ হয়ে যেতে শুরু করেছে হিভরে বাজার। জল বেশি প্রয়োজন হয় বলে নিষিদ্ধ করা হয় আখ ও কলার চাষ। সকলের মিলিত পরিশ্রমে ফের সমৃদ্ধি ফিরল গ্রামে। এতদিন যারা বাইরে ছিলেন, তাদের মধ্যে বেশিরভাগ পরিবারের প্রত্যাবর্তন ঘটে। ১৯৯০ সালে খরা মোকাবিলার জন্য তৈরি হয় যৌথ ব্যবস্থাপনা কমিটি। অর্থ আসতে থাকে মহারাষ্ট্রের কর্মসংস্থান গ্যারান্টি স্কিমের।
১৯৯৫ সালে মাত্র দশ শতাংশ জমি ছিল চাষযোগ্য। আর প্রায় নব্বই শতাংশ পরিবার ছিল দারিদ্র্যসীমার নিচে। কিন্তু ২০১২-র পরিসংখ্যান বলছে সম্পূর্ণ অন্য কথা। ৬০০০ টন ফসল প্রতিবছর উৎপন্ন হয় সেখান থেকে। দুগ্ধজাতীয় পদার্থের উৎপাদন কুড়ি বছরে ১৫০ লিটার থেকে বেড়ে হয়েছে ৪০০০ লিটার। প্রতিটি পরিবারের মাথা পিছু আয় ৩০০০০ টাকার বেশি। অন্তত ৮০টি পরিবারের সম্পত্তি দশ লক্ষ টাকার অধিক। অনুমান, প্রান্তিক গ্রামগুলির মধ্যে হিভরে বাজারের জিডিপি-ই দেশের মধ্যে সবচেয়ে বেশি। মহারাষ্ট্র সরকার থেকে একে ‘আদর্শ গ্রাম’-এর সম্মান পর্যন্ত দেওয়া হয়েছে। ২০২০ সালে ভারত সরকারের ‘পদ্মশ্রী’ খেতাবে সম্মানিত হন পোপটরাও।
আরও পড়ুন
দাবা খেলার হাত ধরেই নেশার হাত থেকে মুক্তি পান এই গ্রামের মানুষ
শুধু অর্থনৈতিক বিকাশ নয়। সামাজিক ও স্বাস্থ্যসচেতনতার দিক থেকেও নজির গড়েছে হিভরে বাজার। জন্মনিয়ন্ত্রণের ফল যেমন প্রত্যক্ষভাবে পেয়েছেন তাঁরা। তেমনই একাধিক সমবায় সংস্থা, নারী ও যুবকদের স্বনির্ভর গোষ্ঠী গড়ে তুলেছেন নিজেরাই। ‘লক্ষপতিদের গ্রাম’ বলে প্রচলিত আখ্যাটা শেষ কথা নয়, বরং নিজের পায়ে দাঁড়ানোর নমুনা তৈরি করেছেন গ্রামবাসীরা। ২০১১ সালে একটি বক্তৃতায় পোপটরাও দাবি করেছিলেন, হাভেরি বাজারে একটিও মশা খুঁজে পাওয়া যাবে না। আর যদি কেউ এই অসাধ্যসাধন করতে পারে, তাকে মশাপিছু ১০০ টাকা দেওয়া হবে। না, আজ পর্যন্ত কেউ সাহস দেখায়নি পোপটরাও-কে মিথ্যাবাদী প্রমাণ করার।
আরও পড়ুন
স্মৃতি-হারানো মানুষদের জন্য ‘নকল’ গ্রাম নেদারল্যান্ডসে
Powered by Froala Editor