১৭৮৮ সালের ৬ এপ্রিল। চিৎপুরের একটি মন্দিরে ঘটে গেল নরবলি। যেমন-তেমন মন্দির নয়, বিখ্যাত চিত্তেশ্বরী মন্দিরে। যার নাম থেকেই চিৎপুর। সেটা ছিল অমাবস্যার রাত। ডাকাতির জন্য সে এক আদর্শ সময়। আর চিত্তেশ্বরী মন্দিরে ডাকাত মতে পুজোর দীর্ঘ ইতিহাস আছে। অনেকের মতে এই মন্দির কলকাতার প্রাচীনতম মন্দির। এই মত যদি ভুলও হয়, তাহলেও মানতেই হবে, কলকাতার অন্যতম প্রাচীন মন্দির এটিই।
জোব চার্নক কলকাতায় পা দেওয়ার ৮০ বছর আগে, অর্থাৎ ১৬১০ সালে মনোহর ঘোষ নামে এক ব্যক্তি মন্দিরটি প্রতিষ্ঠা করেন। বিগ্রহটি আরও পুরনো। স্থানীয় এক ডাকাত চিতে ডাকাত বা চিত্তেশ্বর রায় এই বিগ্রহটি প্রতিষ্ঠা করেন। তাঁর মৃত্যুর পর মনোহর ঘোষ নিত্যসেবার দায়িত্ব নেন। বিপ্রদাস পিপলাইয়ের মনসা মঙ্গলকাব্যে চিৎপুরের উল্লেখ আছে। আর যেহেতু এই নামকরণ দেবীর নাম থেকেই, অতএব এই মূর্তির প্রাচীনতা সম্পর্কে নিঃসংশয় হওয়া যায়। তবে মন্দির প্রতিষ্ঠার পরেও ডাকাতির উপদ্রব কমেনি। আর মনোহর ঘোষ তাই আর এই অঞ্চলে থাকতে না পেরে ব্যারাকপুর চলে যান। সেই ডাকাতির রীতি কতদিন বজায় ছিল, তাই বোঝা যায় সংবাদপত্রের এই প্রতিবেদনটি থেকে।
সেই রাতে কে বা কারা এই কাজ করেছিল, তার কোনো সাক্ষী পাওয়া যায়নি। যে ব্যক্তিকে বলি দেওয়া হয়েছিল, তিনিও কলকাতার স্থানীয় কোনো অধিবাসী নন। সম্ভবত নিকটবর্তী কোনো গ্রাম থেকে তাকে নিয়ে আসা হয়েছিল। নিত্যপুজার আয়োজন সেরে পুরোহিত শোবার ঘরে চলে গেলে এই কাণ্ড ঘটে। অতএব পুরোহিত নিজেও কিছু জানতে পারেননি। সকালে উঠে দেখেন, দেবীমূর্তির পায়ের কাছে একটি মানুষের মাথা পড়ে আছে। আর ধড়টি দরজার কাছে পড়ে।
বলির যাবতীয় আয়োজন শাস্ত্রমতেই করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন পুরোহিত। অতএব যে এই কাজ করেছে, তন্ত্রশাস্ত্রে তার বিশেষ জ্ঞান ছিল। তাছাড়া দেবীর দক্ষিণা হিসাবে একটি বেনারসি শাড়ি, সোনার কণ্ঠমালা এবং একাধিক রুপোর অলঙ্কার নামিয়ে রেখে গিয়েছিল দুষ্কৃতিরা। অতএব তাদের আর্থিক ক্ষমতা সম্পর্কেও একটা ধারণা করা যায়। স্বাভাবিকভাবেই সন্দেহের তির ডাকাতদের দিকে থাকলেও, কাউকে গ্রেফতার করতে পারেনি পুলিশ। তদন্তের স্বার্থে পুরোহিতকে জেরা করা হলে তিনিও নতুন কোনো তথ্য জানাতে পারেননি।
কলকাতা শহরে ডাকাতির ঘটনা তখন প্রায়ই শোনা যেত। তবে ডাকাতির জন্য নরবলির ঘটনা সত্যিই বিরল। পুণ্যলাভের উদ্দেশ্যে পৃথিবীর নানা স্থানে নানা নৃশংস ঘটনা ঘটায় মানুষ। এদেশে নরবলি ছিল সেরকমই। বিভিন্ন তন্ত্র শাস্ত্রে তার নিখুঁত নিয়মকানুন বর্ণনা করা আছে। তবে আজকের শিক্ষিত মানুষের কাছে এমন ঘটনা পৈশাচিক তাণ্ডব ছাড়া আর কিছুই নয়। সেদিনের সেই ডাকাত দলটি কি তাদের পুণ্য অর্জন করতে পেরেছিল? সেকথা অবশ্য আর জানা যাবে না।
তথ্যসূত্র: কলিকাতা সেকালের ও একালের, হরিসাধন মুখোপাধ্যায়