কোভিড পরিস্থিতির মধ্যেই ভারতের ত্রাস হয়ে দাঁড়িয়েছে ছত্রাকঘটিত রোগ। সরকারের প্রকাশিত রিপোর্ট অনুযায়ী ভারতে ব্ল্যাক ফাঙ্গাসে আক্রান্ত হয়েছেন ১২ হাজারেরও বেশি রোগী। তার মধ্যে অধিকাংশ ঘটনাই ঘটেছে গুজরাট এবং মহারাষ্ট্রে। আর এই রোগের সংক্রমণের কারণ হিসাবে স্বাস্থ্য পরিকাঠামোর অভাবের দিকেই আঙুল তুলছেন আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞরা।
তবে মিউকরমাইকোসিস বা ব্ল্যাক ফাঙ্গাস রোগটি নতুন কোনো রোগ নয়। এর আগেও গোটা দেখা যেত তার সংক্রমণ। কিন্তু তার সংখ্যা ছিল হাতে গোনা। শুধু ভারত নয়, গোটা বিশ্বেই কম-বেশি আক্রান্ত হতেন রোগীরা। তবে অন্যান্য দেশের থেকে ভারতে মিউকরমাইকোসিস বা ব্ল্যাক ফাঙ্গাসে আক্রান্ত হওয়ার প্রবণতা ছিল প্রায় ৭০ গুণ বেশি। বলতে গেলে এখন সেই পরিসংখ্যান আকাশ ছুঁয়েছে।
আলবার্টা বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক ও অতিমারী বিশেষজ্ঞ আয়ান সোয়ার্জ এক প্রতিবেদনে জানাচ্ছেন, ব্ল্যাক ফাঙ্গাস নিঃশ্বাসের সঙ্গে প্রতিনিয়তই আমাদের দেহে প্রবেশ করে। তবে আমাদের দেহের প্রতিরোধ ক্ষমতাকে টপকে ক্ষতিসাধণ করতে সক্ষম হয় না এই অণুজীব। কোভিড আক্রান্তদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা অনেকটাই কমে যাওয়ায়, মূলত তাঁদের দেহেই সংক্রমণ হচ্ছে এই রোগের। এবং সঠিক সময়ে চিকিৎসা না হলে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ফলাফল হয়ে উঠছে ভয়ঙ্কর। থেকে যাচ্ছে প্রাণহানীর আশঙ্কাও।
কিন্তু পরিকাঠামোর অভাব কীভাবে প্রকট করে তুলছে এই রোগের প্রকোপ? আয়ান সোয়ার্জ বিশেষভাবে আলোকপাত করছেন কোভিডের চিকিৎসা পদ্ধতিতেই। তিনি জানাচ্ছেন, কোভিড চিকিৎসায় ব্যবহৃত স্টেরয়েড রোগীদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাকে এক ধাক্কায় কমিয়ে দিচ্ছে অনেকটাই। সেইসঙ্গে বাড়িয়ে দিচ্ছে রক্তে শর্করার পরিমাণ। উল্লেখ্য, ভারতে অধিকাংশক্ষেত্রেই সঠিক মাত্রায় ব্যবহৃত হচ্ছে না থেরাপুটিক স্টেরয়েড। অক্সিজেনের ঘাটতির কারণে, চিকিৎসকরা বাধ্য হচ্ছে মাত্রাতিরিক্ত স্টেরয়েড ব্যবহারের জন্য। সেই ঘটনাই পারতপক্ষে ডেকে আনছে ব্ল্যাক ফাঙ্গাসের বিপদকে।
আরও পড়ুন
ব্ল্যাক ফাঙ্গাস থেকে রেহাই নেই বাংলারও, সতর্ক থাকার বার্তা চিকিৎসকদের
কিন্তু কোনোভাবেই কি সম্ভব না কোভিড আক্রান্তদের মধ্যে ব্ল্যাক ফাঙ্গাসের সংক্রমণ আটকানো? হ্যাঁ, সম্ভব। ইন্টারন্যাশনাল সোসাইটি ফর হিউম্যান অ্যান্ড অ্যানিমাল মাইকোলজির সভাপতি অরুণালোক চক্রবর্তী জানাচ্ছেন, পরিচ্ছন্নতার মাধ্যমেই আটকানো যেতে পারে এই ঘাতক ছত্রাককে। হাসপাতালে বিশেষত আইসিইউ-তে এয়ার ফিল্টারের ব্যবহার অনেকটাই কমিয়ে দিতে পারে মিউকরমাইকোসিসের প্রভাব। পরিশুদ্ধ বায়ুতে ছত্রাকের স্পোর না থাকায় রোগীর দেহে সংক্রমণের সম্ভাবনাও কমে যাবে অনেকটাই। কিন্তু সেই ব্যবস্থা হাতে গোনা কয়েকটা হাসপাতাল ছাড়া, কোথাওই নেই ভারতে। ফিল্টার তো দূরের কথা, রোগীদের ভিড় সামলাতে ওয়ার্ডগুলিতে ন্যূনতম পরিচ্ছন্নতারও অভাব রয়েছে বলে অভিমত তাঁর।
আরও পড়ুন
মহারাষ্ট্রে ব্ল্যাক ফাঙ্গাসে মৃত ৫২, নতুন বিপর্যয়ের ইঙ্গিত?
বর্তমান পরিস্থিতিতে কীভাবে তবে আটকানো যাবে এই রোগের প্রকোপ? ডাঃ অরুণালোক চক্রবর্তীর কথায়, ভারতে মিউকরমাইকোসির নিয়ন্ত্রণের একমাত্র হাতিয়ার হতে পারে দ্রুত রোগ নির্ণয় এবং অ্যান্টিফাঙ্গাল ওষুধের যথাযথ ব্যবহার। কারণ, রোগীর অবস্থা আশঙ্কাজনক হয়ে উঠলে তখন বাধ্য হয়েই বেছে নিতে হবে সার্জারির পথ। তাতে যেমন স্থায়ী ক্ষতি হতে পারে রোগীর, তেমনই অর্ধেকের বেশি রোগীর ক্ষেত্রে থেকে যাবে প্রাণনাশের হুমকিও। এমনটাই মনে করছেন তিনি।
কিন্তু সেক্ষেত্রেও সমস্যা সেই স্বাস্থ্য ব্যবস্থার অভাব। ভারতে অধিকাংশ হাসপাতালেই এই রোগের চিকিৎসার জন্য যথাযথ পরিকাঠামো নেই। বাজারে প্রবল ঘাটতি রয়েছে অ্যান্টিফাঙ্গাল ওষুধেরও। ফলে জরুরি তৎপরতায় যাতে ভারতের ওষুধ নির্মাতারা এই ধরনের ওষুধ তৈরিতে জোর দেন, সেই পরামর্শই দিচ্ছেন বিশেষজ্ঞরা। তবে এই ওষুধ অত্যন্ত খরচ-সাপেক্ষ হওয়ায় কতজন রোগী তা কিনতে পারবেন, রয়ে যাচ্ছে প্রশ্ন। ফলে এগিয়ে আসতে হবে সরকারকেও। তবে বিশেষজ্ঞরা জানাচ্ছেন, মিউকরমাইকোসিস আদতে কোনো ছোঁয়াচে রোগ নয়। আক্রান্তের দেহ থেকে অন্য ব্যক্তির দেহে রোগ ছড়িয়ে পড়ার সম্ভাবনা প্রায় নেই বললেই চলে। সুতরাং, স্বাস্থ্য পরিকাঠামোর উন্নয়নই দ্রুত নিয়ন্ত্রণে আনতে পারে এই রোগকে। প্রশ্ন থেকে যায়, সোনার পাথরবাটি হয়েই থেকে যাবে না তো সেই পরিকল্পনা?
তথ্যসূত্রঃ
‘Black fungus’ is creating a whole other health emergency for Covid-stricken India, Ilan Schwartz and Arunaloke Chakrabarti
Powered by Froala Editor