প্রয়াত নেতাজির সহযোদ্ধা, 'ঝাঁসির রানি' রেজিমেন্টের সদস্য অঞ্জলাই পোন্নুস্বামী

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রেক্ষাপট সেটা। বার্মা আক্রমণের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে আইএনএ। নেতাজি পাশাপাশি সেখানে হাজির জাপানের উচ্চপদস্থ সামরিক আধিকারিকরাও। তেমনই এক আধিকারিকের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল বিষয়টি। বিশ্বযুদ্ধের ময়দানে মহিলারা! নেতাজিকে ব্যঙ্গ করেই তিনি প্রশ্ন তুলেছিলেন, ‘কী করতে পারে আপনার মেয়েরা?’ মৃদু হাসির সঙ্গে নেতাজির উত্তর, ‘সেই উত্তর ওরা নিজেরাই দিতে পারে।’

হ্যাঁ, সেদিন উত্তর দিয়েছিলেন ঝাঁসির রানি রেজিমেন্টের তরুণীরা। জাপানি আধিকারিকের দেওয়া চ্যালেঞ্জকে মাটিতে মিশিয়ে দিয়েছিলেন তাঁরা। পিঠের ব্যাগে গোলাবারুদ বোঝাই করে দুর্গম পাহাড়ি জঙ্গল পেরিয়ে পাড়ি দিয়েছিলেন ব্রিটিশ সেনাদের চার্জ করতে। ফিরেছিলেন অক্ষত অবস্থায়। সেদিন জাপানিদের দেওয়া এই চ্যালেঞ্জে সামিল ছিলেন তিনিও। অঞ্জলাই পোন্নুস্বামী (Anjalai Ponnuswami)। গত বছর নেতাজির আইএনএ-র ৮০তম প্রতিষ্ঠাবর্ষে, ভারত বিশেষ শ্রদ্ধাজ্ঞাপন করেছিল বৃদ্ধা আইএনএ (INA Warrior) সেনানীকে। সেইসময়ই গল্পচ্ছলে এ-কথা জানিয়েছিলেন তিনি। 

সম্প্রতি ১০২ বছর বয়সে প্রয়াত হলেন আইএনএ-র প্রবীণা যোদ্ধা। শেষ হল জীবন্ত ইতিহাসের এক দীর্ঘ অধ্যায়। 

ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে অন্যতম অবদান ছিল নেতাজির তৈরি ‘ঝাঁসির রানি’ রেজিমেন্টের। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ তো বটেই, তার পরবর্তী দু-তিন দশকেও সম্পূর্ণভাবে মহিলাদের নিয়ে এহেন পৃথক সেনাবাহিনীর অস্তিত্ব বিশ্বজুড়ে বিরল। তা সত্ত্বেও ইতিহাসের এক অজ্ঞাত অধ্যায় হয়েই রয়েছে আইএনএ-র এই মহিলা ব্রিগেড। 

আরও পড়ুন
নেতাজির বার্তা ছড়াতে সাইকেলে ভারতভ্রমণ কিশোরের

মূলত দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে অক্ষশক্তির হাতে বন্দি ভারতীয়দের নিয়েই আইএনএ গড়ে তুলেছিলেন নেতাজি। তবে ‘ঝাঁসির রানি’ রেজিমেন্টের ক্ষেত্রে ব্যাপারটা ছিল একটু অন্যরকম। এই রেজিমেন্টের অধিকাংশ সদস্যারই বেড়ে ওঠা হয়নি ভারতবর্ষের মাটিতে। তাঁরা সকলেই পূর্ব ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বিভিন্ন দেশের নাগরিক। তবে শরীরে বইছে ভারতীয় রক্ত। অঞ্জলাই-এর ক্ষেত্রেও বিষয়টা তেমনই ছিল। তাঁর জন্ম ও বেড়ে ওঠা মালয়ে। বাবা ছিলেন একজন সাধারণ অ্যান্টি-ম্যালেরিয়া সুপারভাইজার। বেতন ছিল সামান্যই। ফলে, দারিদ্রের মধ্যেই বড়ো হয়ে ওঠা অঞ্জলাই-এর। দ্বিতীয় শ্রেণির পর আর চালিয়ে যেতে পারেননি পড়াশোনাও। ১৯৪৩ সালে জাপান-অধিকৃত মালয়ে এক অদ্ভুত দৃশ্য দেখেন অঞ্জলাই। মালয়ের রাস্তা দিয়ে মার্চড-পাস করেন ঝাঁসির রানির সদস্যরা। তাঁদের দেখে অনুপ্রাণিত হয়ে তিনিও নাম লেখান আইএনএ-র খাতায়। 

আরও পড়ুন
প্রয়াত নেতাজির সহযোদ্ধা লালতি রাম, করোনা কেড়ে নিল আইএনএ সেনাধ্যক্ষকেও

না, শুরুতেই সেনানীর তকমা লাগেনি তাঁর গায়ে। ছুটতে হয়েছিল সিঙ্গাপুরে। চলেছিল কঠোর অনুশীলন। পিস্তল, স্টেন গান, টমি গান, রাইফেল— প্রায় সমস্ত আগ্নেয়াস্ত্র চালানোই আয়ত্ত করেছিলেন তিনি। শিখেছিলেন ফ্রি-হ্যান্ড কমব্যাট। তারপর তাঁর পাড়ি দেওয়া বার্মার উদ্দেশ্যে। স্বপ্ন ছিল ব্রিটিশদের সরিয়ে দিল্লিতে একদিন ভারতের পতাকা উত্তোলন করবেন তিনি। 

আরও পড়ুন
‘বিমান দুর্ঘটনায় মারা যাননি নেতাজি’, রিপোর্ট দিয়েও 'অবহেলিত' বিচারপতি মনোজ মুখার্জি!

তবে শেষ পর্যন্ত সম্পূর্ণ হয়নি সেই স্বপ্ন। মিত্রশক্তির কাছে বশ্যতা স্বীকার করতে বাধ্য হয় জাপান এবং জার্মানি। ভেঙে যায় আইএনএ। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর অঞ্জলাই ফিরে গিয়েছিলেন মালয়ে। জীবদ্দশায় ভারত এবং মালয়েশিয়া দুই দেশেরই স্বাধীনতা দেখেছেন তিনি। তবে স্বাধীনতা অর্জনের পরেও থেমে থাকেনি তাঁর লড়াই। 

নেতাজির আদর্শকে পাথেয় করেই তিনি লড়ে গেছেন নারীদের সমানাধিকারের জন্য। হয়ে উঠেছিলেন মালয়েশিয়ার অন্যতম প্রতিবাদী চরিত্র। যদিও কোনোদিনই রাজনীতির মুখ হয়ে ওঠেননি তিনি। নেতাজির ‘ঝাঁসির রানি’ রেজিমেন্টে পূর্ণ স্বাধীনতা পেতেন মহিলা সৈনিকরা। পুরুষদের মতো সমান বেতন পেতেন তাঁরাও। পেতেন সমপরিমাণ রেশন। এই একই দাবিতে মালয়েশিয়ায় তিনি লড়াই চালিয়ে গেছেন দীর্ঘদিন। সঙ্গী ছিলেন আইএনএ-র আরও এক মহিলা যোদ্ধা রাসামা ভূপালন। হ্যাঁ, শেষ পর্যন্ত জয় ছিনিয়ে এনেছিলেন সরকারের কাছ থেকে। প্রবর্তিত হয়েছিল বিশেষ আইন। 

জীবনের শেষ বয়সেও যথেষ্ট সুস্থ-সামর্থ্যই ছিলেন অঞ্জলাই। বছর কয়েক আগে দুর্ঘটনায় চলচ্ছক্তি হারালেও, হুইলচেয়ারে চেপে নিজেই সারতেন বাড়ির ছোটোখাটো কাজ। সেইভাবে অন্যের সাহায্যের দরকার পড়েনি তাঁর। গত বৃহস্পতিবার আকস্মিক হৃদরোগ আক্রান্ত হন অঞ্জলাই। ব্যর্থ হন চিকিৎসকরা। 

মালয়েশিয়ার কোয়ালা লামপুর নিবাসী ১০২ বছরের প্রবীণাই ছিলেন আইএনএ-র জীবন্ত ইতিহাস। ছিলেন ভারত এবং মালয়েশিয়ার ইতিহাস ও সংস্কৃতির অন্যতম সেতু। এবার তাঁর প্রয়াণে মুছে গেল ইতিহাসের আস্ত একটি অধ্যায়ের অস্তিত্ব…

Powered by Froala Editor