প্রয়াত নেতাজির সহযোদ্ধা লালতি রাম, করোনা কেড়ে নিল আইএনএ সেনাধ্যক্ষকেও

তখন সবে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হয়েছে। তবে উত্তপ্ত ভারতের পরিস্থিতি। রাজত্বের সময় যে ফুরিয়ে এসেছে, তা স্পষ্ট হয়ে গিয়েছিল ব্রিটিশ শাসকদের কাছে। তবুও স্বাধীনতা সংগ্রামীদের ছত্রভঙ্গ করে দেওয়ার প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে তারা। ১৯৪৬ সালের ১৬ এপ্রিল। আইএনএ-র একদল সেনাকে কলকাতার জেল থেকে দিল্লিতে পাঠানোর বন্দোবস্ত করল ব্রিটিশ সরকার। বন্দিদের নিয়ে যাওয়ার জন্য ট্রেনের একটি কামরাকেই বদলে ফেলা হল কারাগারে। সেইসঙ্গে সশস্ত্র প্রহরী তো আছেই। তবে সফল হল না প্রয়াস। এলাহাবাদ স্টেশনেই গরাদ এবং তালা ভেঙে বেরিয়ে এলেন আজাদ হিন্দের সেনারা। সেদিন তাঁদের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন আইএনএ-র সেনাধ্যক্ষ লালতি রাম।

গত শুক্রবারই করোনায় আক্রান্ত হয়েছিলেন তিনি। নিয়ে যাওয়া হয়েছিল রোহটাক পিজিআই হাসপাতালে। তবে এই সংকটের সময় খালি শয্যাই কোথায়? ফলত, কিছু ওষুধ দিয়েই ফিরিয়ে দিয়েছিল হাসপাতাল। বাড়িতে চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হলেও, শেষ পর্যন্ত বাঁচানো গেল না তাঁকে। রবিবার সকালেই শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন আইএনএ-র বীরযোদ্ধা লালতি রাম। চলতি বছরেই একশোতে পা দিয়েছিলেন তিনি।

১৯২১ সালের ১ জানুয়ারি হরিয়ানার ঝাঁঝর জেলার দুবালধন গ্রামে জন্ম তাঁর। অল্প বয়স থেকেই জড়িয়ে পড়েছিলেন স্বাধীনতা সংগ্রামে। গোটা দেশ তখন অগ্নিগর্ভ। স্বাধীনতার জন্য ফুটছে তরুণ সমাজ। তিনিও যোগ দিলেন হরিয়ানার স্বতন্ত্রতা সেনানী সমিতিতে। অল্পদিনের মধ্যেই সেই সংগঠনের চেয়ারম্যান হয়ে উঠলেন তিনি। অন্যদিকে সেইসময় স্বপ্নের সৈন্যবাহিনী তৈরির জন্য যুবকদের খুঁজে বেড়াচ্ছেন সুভাষচন্দ্র। তাঁর সংস্পর্শে এলেন লালতি রাম। দেশের জন্য প্রাণ দেওয়ার প্রস্তুতি তো আগেই নিয়েছিলেন তিনি। এবার নাম লেখালেন আজাদ হিন্দ ফৌজে। পাড়ি দিলেন বিদেশ।

তাঁকে সন্তানসম স্নেহ করতেন স্বয়ং নেতাজি। দায়িত্ব দিয়েছিলেন আজাদ হিন্দ ফৌজের সেনাধ্যক্ষের। বিশ্বযুদ্ধ চলছে তখন। ফলত, বিপ্লবী কর্মকাণ্ডের জন্য ‘ওয়ার ক্রিমিনাল’ হিসাবেই তিনি গ্রেপ্তার হয়েছেন একাধিকবার। অম্বালা, সিঙ্গাপুর, হংকং, থাইল্যান্ড এমনকি জাপানেও জেল খেটেছেন তিনি। তবে প্রতিবারই পুলিশের চোখে ধুলো দিয়ে বেরিয়ে এসেছিলেন লালতি রাম। নির্ভীকতার জন্য পেয়েছিলেন আজাদ হিন্দ সরকারের তিনটি মেডেল। 

আরও পড়ুন
‘বিমান দুর্ঘটনায় মারা যাননি নেতাজি’, রিপোর্ট দিয়েও 'অবহেলিত' বিচারপতি মনোজ মুখার্জি!

নেতাজির অন্তর্ধানের পর বেশ কয়েক বছর নিখোঁজ ছিলেন তিনি। বিশ্বযুদ্ধের পরে ১৯৪৬ সালে দেশে ফেরা। বিবাহ। তবে সতর্ক ছিল ব্রিটিশ সরকারও। ফের গ্রেপ্তার হলেন কলকাতায়। অনেক চেষ্টা করেও তাঁর থেকে আজাদ হিন্দ সরকারের গোপন তথ্য বের করতে সমর্থ হয়নি পুলিশ। শেষ পর্যন্ত দিল্লিতে তাঁকে স্থানান্তরিত করার সিদ্ধান্ত নেয় ব্রিটিশ সরকার। ব্যর্থ হয়েছিল সেই চেষ্টাও। 

আরও পড়ুন
নেতাজির ছবি থাকুক নোটে, আবেদনের নিষ্পত্তি করতে কেন্দ্রের দ্বারস্থ মাদ্রাজ হাইকোর্ট

স্বাধীনতার পরও যোগ্য সম্মান পাননি তিনি। লালতি রাম কেন, আইএনএ-র কোনো সেনাকেই জায়গা দেওয়া হয়নি স্বাধীন ভারতের সেনাবাহিনীতে। কিন্তু তারপরেও এতটুকু কমেনি দেশাত্মবোধ। নিজের পাঁচ সন্তানকেই তিনি পাঠিয়েছিলেন ভারতের সেনাবাহিনীতে। এমনকি দেশের সেনাবাহিনীতে বর্তমানে কর্মরত তাঁর আট পৌত্র। নাতনি পুলিশ অফিসার। 

আরও পড়ুন
তাঁর সঙ্গে খাবার ভাগ করে নিতেন নেতাজি; কৈশোরের স্মৃতিতে ডুবে ৯৩ বছরের নাগা বৃদ্ধ

২০১৯ সালে আজাদ হিন্দ সরকার প্রতিষ্ঠার ৭৫তম বর্ষে তাঁকে বিশেষ সম্মান দিয়েছিল ভারত সরকার। লালকেল্লায় দাঁড়িয়ে সেদিন তিনি নির্ভীক কণ্ঠে বলেছিলেন, নেতাজি সম্পর্কিত কোনো তথ্যই প্রকাশ্যে আনতে চায় না ক্ষমতাসীন কোনো দল। আর সেই তথ্য সামনে আসবেও না কোনোদিন। 

শেষ জীবনেও কি তিনি বঞ্চিত হলেন না যোগ্য সম্মান থেকে? এমন একজন ব্যক্তিত্বের চিকিৎসার জন্য কি বাড়তি কোনো পদক্ষেপ নিতে পারত না সরকার? থেকে যাচ্ছে এই প্রশ্নই। যদিও বিদায়বেলায় রাষ্ট্রীয় সম্মানে তাঁকে সম্মানিত করেছে প্রশাসন। তাঁর শেষকৃত্যে উপস্থিত ছিলেন জেলা শাসক থেকে শুরু করে একাধিক প্রশাসনিক প্রধানরা। লালতি রাম শুধু স্বাধীনতার সংগ্রামীই নয়, ছিলেন ইতিহাসের এক জীবন্ত দলিল। তাঁর মৃত্যুর সঙ্গে ইতি পড়ল সেই চলমান অধ্যায়ে…

Powered by Froala Editor