সামাজিক বয়কট, নিগ্রহ জয় করে রূপান্তরকামীদের আশা দেখাচ্ছেন অভিনা

একুশ শতকের একেবারে গোড়ার কথা। লিঙ্গপরিচয় নিয়ে ভারতে তখনও প্রায় কোনো সচেতনতাই গড়ে ওঠেনি। আর ইন্টারনেটের ব্যবহারও শুরু হয়নি যে, দেশবিদেশের খবর এসে পৌঁছাবে হাতের মুঠোয়। এমন সময় মুম্বাইয়ের এক বছর কুড়ির যুবক অনুভব করেন, তাঁর নিজের পরিচয়ে তিনি খুশি নন। বয়ঃসন্ধির পর থেকে যে সমস্ত শারীরিক পরিবর্তন শুরু হয়েছে, তাতে তাঁর যথেষ্ট অস্বস্তিই হচ্ছে। তিনি আসলে মনেপ্রাণে একজন নারী। কিন্তু রূপান্তরকামীদের মনের কথা প্রকাশ্যে জানানো আজও কঠিন। সেদিন তো বটেই। প্রথমেই বাড়িতে মায়ের কাছে বকুনি খান তিনি। এমন কথা সবাই জেনে গেলে সমাজে মুখ দেখানো যাবে না। তার সঙ্গে কলেজে সহপাঠীদের নির্যাতনও চলতে থাকে। তবে সেই সমস্ত বাধা পেরিয়ে আজ অভিনা আহের (Abhina Aher) নিজের প্রকৃত পরিচয় নিয়েই মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়েছেন। সেইসঙ্গে আরও বহু রূপান্তরকামী মানুষের প্রেরণাও হয়ে উঠেছেন তিনি।

অভিনার বয়স এখন ৪৪ বছর। তিনি ভারতের প্রথম রূপান্তরকামীদের পেশাদার নাচের দল ‘ডান্সিং কুইন’-এর প্রতিষ্ঠাতা। পাশাপাশি আরও নানারকম সামাজিক কাজে যুক্ত থাকেন তিনি। এর মধ্যে এইডস বিরোধী প্রচার যেমন রয়েছে, তেমনই রয়েছে রূপান্তরকামী মানুষদের জন্য সম্মানজনক জীবিকার ব্যবস্থা করা। বিভিন্ন সামাজিক সংগঠন এবং এনজিও-র সঙ্গে কাজ করেছেন তিনি। ২০১৩ সালে নিজেই তৈরি করেছেন একটি এনজিও, টুইট (ট্রান্সজেন্ডার ওয়েলফেয়ার ইকুইটি অ্যান্ড এমপাওয়ারমেন্ট ট্রাস্ট)। মুম্বাই শহর সহ সারা মহারাষ্ট্রের সমস্ত রূপান্তরকামীর সামাজিক সুরক্ষার জন্য চালু করেছেন একটি হেল্পলাইন নাম্বারও।

শৈশবেই বাবাকে হারিয়েছিলেন অভিনা। মায়ের স্নেহ পেয়েই বেড়ে উঠেছেন তিনি। বৃহন্মুম্বাই মিউনিসিপ্যাল কর্পোরেশনের কর্মী ছিলেন অভিনার মা। সেইসঙ্গে বেশ কিছু জায়গায় মারাঠি লোকনৃত্য করেছেন নিয়মিত। কিছু মারাঠি সিনেমাতেও অভিনয় করেছেন। মায়ের কাছেই নাচ শেখা অভিনার। ছোটো থেকেই মায়ের শাড়ি পরে নাচতে ভালো লাগত তাঁর। তখন তাঁর মাও খুশি হতেন এইসব দেখে। কিন্তু একদিন দৃশ্যটা বদলে গেল। বয়ঃসন্ধির পর তাঁর এমন আচরণ মা মেনে নিতে পারলেন না। একদিকে মায়ের সন্ত্রস্ত মুখ, অন্যদিকে সহপাঠীদের অত্যাচার – এই নিয়েই জীবন কাটছিল। একদিন কলেজে তাঁর সহপাঠীরা শারীরিক নিগ্রহও করেন তাঁকে। আর এসবের মধ্যেই অভিনার জেদ আরও বেড়ে যায়। ২৭ বছর বয়সে প্রথম লিঙ্গপরিবর্তনের অপারেশন করেন তিনি।

এরপর অবশ্য মায়ের সঙ্গে কথাবার্তা প্রায় বন্ধ হয়ে যায়। এদিকে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়াশোনা শেষ করেও কোনো চাকরি পাননি। কারণ রূপান্তরিত মহিলাদের চাকরি দিতে রাজি হয়নি কেউই। বাধ্য হয়েই রোজগারের আশায় যৌনকর্মীর জীবিকা বেছে নিতে হয় তাঁকে। অবশ্য এই সময়েই হঠাৎ সুদিনের সন্ধান পান তিনি। যৌনপল্লীতে থাকার কারণেই বেশ কিছু এনজিও-র সঙ্গে যোগাযোগ হয় তাঁর। আর তাঁদের মাধ্যমেই সামাজিক কাজ শুরু করেন তিনি। প্রথমে এইডস বিরোধী প্রচারই ছিল তাঁর কাজ। এরপর একে একে পুরুষতন্ত্রের বিরুদ্ধে নানারকম ইস্যুকেই তুলে নিয়েছেন অস্ত্র হিসাবে। ২০১৩ সালেই তাঁর নাচের দল ‘ডান্সিং কুইন’-এরও জন্ম। তবে এখনও তাঁর কাজ শেষ হয়নি। হয়তো এক জীবনে এই কাজ শেষ হওয়ারও নয়। দেশের সমস্ত রূপান্তরকামী মানুষ যেদিন স্বোচ্চারে নিজেদের পরিচয় সামনে আনতে পারবেন, সেদিনই অভিনার স্বপ্ন পূরণ হবে।

আরও পড়ুন
রূপান্তরকামী প্রার্থী নিয়োগের সিদ্ধান্ত কর্ণাটক পুলিশের

Powered by Froala Editor

আরও পড়ুন
দেশের দ্বিতীয় রূপান্তরকামী হিসাবে পদ্মশ্রী পেলেন কর্ণাটকের যোগাপ্পা নৃত্যশিল্পী