বিবাহবিচ্ছেদের জন্য মরণপণ ডুয়েল লড়তে হত স্বামী-স্ত্রীকে! মধ্যযুগের এক বর্বর প্রথা

যে-কোনো সম্পর্কের মধ্যেই তিক্ততা তৈরি হলে প্রভাবিত হয় মানসিক স্বাস্থ্য। আর সেটা যদি স্বামী-স্ত্রীয়ের সম্পর্ক হয়, তবে সেই তিক্ততা বিষিয়ে তোলে গোটা পরিবারকে। রোজকারের ঝগড়া, ঝামেলা, কটূক্তি, আইনি মামলা— সবমিলিয়ে বিবাহবিচ্ছেদের পরিস্থিতি স্বাস্থ্যকর হয় না অধিকাংশ ক্ষেত্রেই। তবে আজ থেকে পাঁচশো বছর আগে, বিবাহবিচ্ছেদের পদ্ধতি ছিল আরও নির্মম। বিবাহের বন্ধন থেকে মুক্ত হতে গেলে হয় প্রাণ দিতে হত নিজেকে, নয় প্রাণ নিতে হত জীবনসঙ্গীর। 

হ্যাঁ, শুনতে আশ্চর্য লাগলেও সত্যি। মধ্যযুগীয় জার্মানিতে বিবাহবিচ্ছেদ (Divorce) করতে গেলে নৃশংস এক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের (Combat) পথেই হাঁটতে হত দম্পতিদের। আনুমানিক পঞ্চদশ শতকের শুরু থেকেই এই বিশেষ রীতির প্রচলন হয় জার্মানিতে। যা শুধু সামাজিকভাবেই নয়, স্বীকৃত ছিল আইনিভাবেও। কিন্তু প্রশ্ন থেকে যায়, শারীরিক সক্ষমতার বা শক্তির দিক থেকে দেখতে সাধারণভাবে নারীদের থেকে এগিয়ে থাকেন পুরুষরা। সেক্ষেত্রে কি সবসময় পুরুষরাই জিততেন ‘ডিভোর্স ডুয়েল’-এ (Divorce Duel)? তা তেমনটাই যদি হয়ে থাকে তবে সবকিছু জেনে-বুঝেই বা কেন মহিলারা এই রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে অংশ নিতেন বিবাহবিচ্ছেদের জন্য? 

না, ইতিহাস বলছে এই ‘ডিভোর্স ডুয়েল’ লড়া হত সমানে সমানে। পুরুষ শারীরিকভাবে নারীর চেয়ে শক্তিশালী হলেও, বিশেষ কিছু নিয়ম মেনেই লড়তে হত তাঁদের। আইনিভাবে দেখা হত, নারীরাও যাতে কোনো অংশ পিছিয়ে না থাকে। সেটা কেমনভাবে সম্ভব? 


‘ডিভোর্স ডুয়েল’-এর সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য ঐতিহাসিক দলিল হিসাবে ধরে নেওয়া হয় জার্মান ফেন্সিং মাস্টার হান্স তালহফার-এর লিখিত ডায়েরি থেকে। ডায়েরি না বলে, এই খাতাকে বই বলাই ভালো। ‘ফেইচবুচে’ বা ‘দ্য ফাইট বুক’-খ্যাত এই ডায়েরিতেই তিনি লিপিবদ্ধ করে গিয়েছিলেন ডিভোর্স ডুয়েলের সমস্ত নিয়ম। পাশাপাশি ছবি এঁকেও তিনি বুঝিয়ে দিয়েছিলেন কীভাবে লড়তে হবে লড়াই ডুয়েল-যোদ্ধাদের। 

এই ডায়েরি থেকেই জানা যায়, সাধারণত মহিলারা লড়াতেন মাটিতে দাঁড়িয়ে। অন্যদিকে পুরুষদের লড়তে হত কোমর পর্যন্ত খোঁড়া গর্তের মধ্যে দাঁড়িয়ে। উচ্চতা বা শক্তি জন্য যাতে বাড়তি সুবিধা না মেলে পুরুষদের— তার জন্যই এই আশ্চর্য নিয়ম। শুধু তাই নয়, স্বামী ও স্ত্রী যোদ্ধারের লড়াইয়ের হাতিয়ারও ছিল ভিন্ন। পুরুষদের লড়তে হত ভারী কাঠের মুগুর দিয়ে। অন্যদিকে মহিলারা লড়াই করতেন কাপড়ের একটি থলি নিয়ে। যার মধ্যে পাথর ভরে, ভালো করে বেঁধে দেওয়া হত শেষপ্রান্ত। এতে শারীরিক সক্ষমতা কম হলেও, দূর থেকে ‘প্রাক্তন’ জীবনসঙ্গীকে আঘাত করার সুযোগ পেতেন তাঁরা। এমনকি লড়াই শুরুর আগে কাপড়ের এই থলের দৈর্ঘ্য ও কাঠের মুগুরের দৈর্ঘ্য সমান কিনা তা পরীক্ষা করে নিতেন প্রশাসনিক আধিকারিকরা। 

ওকলাহোমা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক কেনেথ এল হজেসের গবেষণা অনুযায়ী, মধ্যযুগ তো বটেই, ‘ফেইচবুচে’ প্রকাশিত হওয়ার পর নবজাগরণের যুগে বিশেষ করে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল এই বৈবাহিক ডুয়েল। আজকের দিনে যেমন আদালতে বিচার বা ট্রায়াল দেখতে ভিড় জমান অনেকে, তেমন এই ডুয়েল দেখতেও দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে হাজির হতেন সাধারণ মানুষ। কিন্তু সাধারণ বিচারপদ্ধতি ছেড়ে এই সহিংস পথে হাঁটার কারণ কী?

বেশ কিছু ঐতিহাসিক নথি প্রমাণ হিসাবে রেখে, কেনেথ দাবি করেছেন, প্রতিষ্ঠিত আইনি ব্যবস্থার পক্ষপাতিত্বের জন্য সে-সময় তিক্ত হয়ে উঠেছিল সাধারণ মানুষ। জার্মানিতে তখন রাজা বা প্রশাসনের ঘনিষ্ঠ হলে, এইধরনের মামলায় বেশিরভাগ রায় যেত পুরুষদের পক্ষে। মহিলাদের বিবাহবিচ্ছেদের আবেদনে অনেকক্ষেত্রেই স্বাক্ষর করতেন না বিচারকরা। এই পক্ষপাতিত্ব মুছে ফেলার জন্যই প্রবর্তিত হয় ‘ডিভোর্স ডুয়েল’। যেখানে স্বামী-স্ত্রীকেই নির্ধারণ করতে হত তাঁদের ভাগ্য, থুড়ি পরিণতি। আনুমানিক ষোড়শ শতকের শেষ বা সপ্তদশ শতকের শুরুর দিক থেকে ধীরে ধীরে বন্ধ হয়ে যায় এই রক্তক্ষয়ী প্রথা। বদলে, ফের বিবাহবিচ্ছেদ সংস্ক্রান্ত মামলার দায়িত্ব তুলে দেওয়া হয় বিচার ব্যবস্থার হাতেই। 

Powered by Froala Editor