১৮৬৮ সাল। আজ থেকে প্রায় দেড়শো বছর আগেকার কথা। আজকের মতোই এক সংক্রামক রোগ থাবা বসিয়েছিল কলকাতা ও তার আশেপাশের কিছু জায়গায়। তবে সেটা ছিল অঞ্চল বিশেষে এবং একটি নির্দিষ্ট গোষ্ঠীর মধ্যে। সেই ইতিহাস জানতে আরেকটু পিছিয়ে যেতে হয়। ইংরেজ সরকারের কাছে তাদের সৈন্যরা খুবই গুরুত্বপূর্ণ ছিল। যৌনকর্মীদের সংস্পর্শে আসার জন্য তাদের মধ্যে হঠাৎ করে যৌনরোগের প্রার্দুভাব বেড়ে যায়। সরকারি রিপোর্ট অনুযায়ী, ১৮২৭ সালে ইংরেজ সৈন্যদের মধ্যে এই যৌনরোগের হার ছিল ২৯%; যা ১৮২৯-এ বেড়ে দাঁড়ায় ৩১% আর ১৮৬০ সালে ৭০%। স্বাভাবিকভাবে সরকারে অচলাবস্থায় পরিণত হওয়ার অপেক্ষায়। ফলে অনেক সৈন্যকেই বরখাস্ত করা হয়।
কিন্তু এইভাবে বেশিদিন চলতে দেওয়াও যাচ্ছিল না। অন্যদিকে এই বৃত্তিও বন্ধ করে দেওয়া অসম্ভব ছিল। তাই সমস্ত দিক বিচার করে সরকার পাস করলেন ‘ক্যান্টনমেন্ট আ্যক্ট’(Act XXII of 1864)। সেনা ছাউনিগুলোতে সেনাবাহিনীদের জন্য তৈরি হল আলাদা যৌনপল্লি। সেখানে যেসব যৌনকর্মীরা আসতেন তাঁদের রেজিস্ট্রিভুক্ত পরিচয়পত্র সহ কার্ড দেওয়া হত। কিন্তু এতকিছু করেও যৌনরোগের প্রার্দুভাব আটকানো যাচ্ছিল না।
কলকাতার হেলথ অফিসার ফেরার টনেয়র এই অবস্থার ব্যাখ্যা দিয়েছিলেন। তাঁর মতে, সিফিলিসের মতো রোগ শুধু সৈন্যদের মধ্যে নয়, সাধারণ মানুষের মধ্যেও ছড়িয়ে পড়ছে। তিনি ১৮৬৭ সালে একটি “মেমরন্ডাম” তৈরি করেছিলেন। সেখানে তিনি দেখিয়েছিলেন কলকাতায় তখন ৩০,০০০ যৌনকর্মী। তাঁদের থেকে ছড়িয়ে পড়া সংক্রমিত যৌনরোগকে আটকানোর জন্য তিনি তৈরি করলেন খসড়া - “contagious Diseases Act of 1868”। বাংলার সরকার তাঁর এই মতকে সমর্থন জানিয়ে ১৮৬৮ সালে এই অ্যাক্ট বা চৌদ্দ আইন চালু করলেন। যৌনকর্মীদের সামাজিক অবস্থানের মূল্য পাল্টে গেল এই আ্যক্ট বা আইনের মধ্যে দিয়ে। এই আইনগুলো অনেক সময়েই এত প্রশাসনিক হেনস্থা, অসম্মান-অপমানের হয়ে উঠেছিল যে, তাঁরা পরিস্থিতি থেকে মুক্ত হওয়ার চাইতে আরও দুঃখ দুর্দশার দিকে এগিয়ে গিয়েছিলেন।
সরকারি নির্দেশে পুলিশ লালাবাতি এলাকায় বাড়িগুলোতে তল্লাশি চালিয়ে মেয়েদের ডাক্তারি পরীক্ষা করাতে নিয়ে যেত। সরকারের তাঁদের প্রতি এই ব্যবহার ক্রমশই নৃশংসতার মাত্রা ছাড়িয়ে যাচ্ছিল। তাঁদের অবশ্যই রেজিস্ট্রিভুক্ত হতে হত। তবে তারও আগে ডাক্তারখানায় গিয়ে ডাক্তার পরীক্ষা করাতে হত। সেটা ছিল তাঁদের কাছে প্রায় অত্যাচার! পরীক্ষা পদ্ধতিটিও ছিল খুব যন্ত্রণাদায়ক। ২০ এপ্রিল, ১৮৬৯ সালের 'সম্বাদ ভাস্কর' পত্রিকায় 'চৌদ্দ আইনের ব্যাপার' শিরোনামের প্রতিবেদনে জানানো হচ্ছে, “তাঁহারা ওই পরীক্ষিত বেশ্যাগণকে প্রথমত টবে বসাইয়া দেন, তাঁহারই জলের সহিত জ্বালাকর পদার্থ থাকে, ওই পরীক্ষার পর গর্ভ দর্শনীয় বিশাল যন্ত্র দ্বারা দর্শন হয়, পরে উগ্রতর পিচকারি দেওয়া হইয়ে থাকে। জনরবরারীরা বলেন এই পিচকারিতে অনেকের উদর ফুলিয়া জীবন সংশয় হইয়াছে।”
তাঁরা রোগমুক্ত কিনা, সে সার্টিফিকেট দিত ডাক্তার। যৌনরোগ যাদের থাকত না তাঁরা পেশায় ফিরে যেতেন। যাঁরা রোগাক্রান্ত থাকতেন, তাঁদের পাঠানো হত লক হাসপাতালে। এই লক হাসপাতালের ভাবনা এসেছিল ইংল্যান্ড থেকে, যেগুলো তৈরি করা হয়েছিল নেকড়েদের আটকে রাখার জন্য। সরকারের তাঁদের প্রতি এই বিরূপ মনোভাবের ফলে প্রচুর যৌনকর্মী কলকাতা ছেড়ে অন্য জায়গায় বা গ্রামে পালাতে শুরু করলেন। যাঁরা হাসপাতালে গেলেন তাঁদের মধ্যে অধিকাংশই ফিরে এসে পুরোনো পেশায় ফিরতে আর সাহস পেলেন না। তাঁদের যেন পেশায় টিকে থাকাই দায় হয়ে পড়েছিল। এমনকি শেষ পর্যন্ত খদ্দেরদের মধ্যেও অনীহা জন্মাল লালবাতি এলাকায় যাওয়ার। কোনো কোনো যৌনকর্মী আবার কলকাতা ছেড়ে ফরাসডাঙ্গাতেও চলে গিয়েছিলেন, কারণ সেই জায়গাটা ছিল ফরাসিদের আওতাভুক্ত। ইংরেজদের আইন সেখানে বলবৎ হত না।
উনিশ শতকের বাবু সমাজ এই যৌনকর্মীদের নিয়ে দুভাগে ভাগ হয়ে গিয়েছিল। একদল ছিল তাঁদের সহমর্মী, যাদের মধ্যে সেকালের বিখ্যাত লোক বিশেষ ছিল না, ছিল সাধারণ মানুষ। আর বিখ্যাত মানুষদের ইমেজ রক্ষার দায়বদ্ধতা ছিল বলে তাঁরা প্রকাশ্যে অনেকেই এঁদের সমর্থন করেননি। এই সময়ে প্রচুর ‘বটতলা’র বইপত্রে বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে যৌনকর্মীদের প্রসঙ্গ উঠে এসেছে। ১৮৬৮ সালের 'ইন্ডিয়ান কন্টাজিয়াস ডিজিসেস আ্যক্ট' চালু হওয়ার পর ওই বছরই সেই আইনকে বাংলায় অনুবাদ করে বই আকারে প্রকাশ করা হয়। নাম দেওয়া হয় ‘বেশ্যা গাইড’। শ্রীগিরীশচন্দ্র মুখোপাধ্যায় সংগৃহীত। ৩১ পৃষ্ঠার আইনি খুঁটিনাটি-সহ যৌনকর্মীদের কতর্ব্য বিস্তারিতভাবে আলোচিত হয়েছে এই বইতে। এই বইকে কেন্দ্র করে সমাজের বিভিন্ন স্তরের মানুষের মধ্যে আলাপ আলোচনা তর্ক বিতর্কের ঝড় বয়ে গিয়েছিল। যৌনকর্মীরাও তাঁদের দুর্গতির কথা জানাতে গিয়ে এই বইয়ের সরল বাংলায় লেখা ধারাগুলোর শরণাপন্ন হয়েছেন।
তবে চৌদ্দ আইন নিয়ে যথেষ্ট ঝড় উঠেছিল সেসময়। যৌনকর্মীরাও বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় নিজেদের দুর্দশার কথা জানিয়ে সরকারের ওপর যে চাপ সৃষ্টি করতে পেরেছিলেন। তাছাড়া সরকারি কিছু অফিসার লক্ষ করছিলেন যে তাঁদের রাজস্বের অনেকটাই ব্যয় হয়ে যাচ্ছে এই আইন প্রয়োগ করতে গিয়ে। যৌনকর্মীদের নিয়ন্ত্রণ করাও যাচ্ছে না আর সৈন্যদের মধ্যে যৌনরোগের প্রার্দুভাবও খুব বেশি কমছে না। সব ভেবেচিন্তে ১৮৮৮-তে এই আইনটি সরকার বাতিল করল। এই আইন ও তাতে জড়িত যৌনকর্মীদের নিয়ে বই, পাঁচালি, কবিতা, কতকিছু লেখা হয়েছিল।
১৮৬৮ সালের পরও অনেক বড়ো বড়ো সংক্রমিত রোগের সংঘাত পেরিয়ে আজ ২০২০-তে এসে আমরা করোনায় আক্রান্ত। দীর্ঘদিন লকডাউন। তার শিকার আজকের সোনাগাছি, কালীঘাট, খিদিরপুর, বৌবাজার। সেই সময়ে নিজেদের বাঁচাতে লালবাতি এলাকার মেয়েরা অনেকেই চলে গিয়েছিলেন ফরাসডাঙ্গায়, চন্দননগরের ফরাসি কলোনিতে যেখানে ইংরেজের আইন বলবৎ হবে না। কিন্তু আজ তো কোথাও পালানোর পথ নেই! সব বন্ধ। সব। রাত নেমে আসলে তাই লাল নীল পরীরা নামে না আর এই শহরে। ফাঁকা চিত্তরঞ্জন এভিনিউ জুড়ে পড়ে থাকে নিঃসীম এক শূন্যতা।
তথ্যসূত্র: বেশ্যাপাড়ার পাঁচটি দুর্লভ সংগ্রহ, মৌ ভট্টাচার্য, ২০১১, আনন্দ পাবলিশার্স।