কথায় বলে ‘যদি হও সুজন, তেঁতুল পাতায় ন’জন’। তা বলে গোটা একটা শহর এক ছাদের তলায়! শুনতে অবিশ্বাস্য লাগলেও সত্যি। প্রবল শীতের মধ্যে ঘরের উষ্ণতা ছেড়ে বাইরে যেতে ভালো লাগে না কারোরই। আর সেই তাপমাত্রা যদি হয় মাইনাস তিরিশের আশেপাশে, তবে তো আর কথাই নেই। তখন ব্যাপারটা আর ইচ্ছের উপর নির্ভর করে না, টানাটানি পড়ে যায় জীবন নিয়ে। তাই সব মানুষই মিলেমিশে থাকে একটা বাড়ির মধ্যে। পড়াশোনা থেকে বিনোদন, প্রশাসন থেকে খেলাধুলো সব ব্যবস্থাই আছে এখানে।
কথা হচ্ছে আমেরিকার উত্তরে আলাস্কার (Alaska) হুইটিয়ের (Whittier) শহর নিয়ে। সুমেরু অঞ্চলের একেবারে গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে থাকা এই শহরটিকে প্রায় সারা বছর লড়াই করতে হয় ঠান্ডার সঙ্গে। গ্রীষ্মকালে যদিও বা সড়ক পথে যোগাযোগ রাখা সম্ভব হয়, শীতকালে হুইটিয়ের সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় বাইরের দুনিয়া থেকে। বছর পনেরো আগে তৈরি হওয়া রেলপথটির কোনো প্রয়োজনই পড়ে না আর। তুষারঝড়ের কারণে দিনের পর দিন থাকতে হয় ঘরবন্দি। কোনো কারণে বাইরে গেলে থেকে যায় প্রাণের ঝুঁকি। বরফের চাদরে ঢেকে যায় গোটা শহর। ফলে উপায় একটাই। চৌদ্দ তলার বেগিচ টাওয়ারেই (Begich Tower) থাকেন শহরের প্রায় অধিকাংশ মানুষ।
অবশ্য খুব বেশি জনসংখ্যা নয় শহরটির। বড়ো জোর ২০০ লোকের বাস এখানে। ২০১৮ সাল পর্যন্ত সকলেই থাকতেন বেগিচে, কিন্তু তারপর কিছু মানুষ বেরিয়ে গিয়ে থাকতে শুরু করেন বাকনার বিল্ডিংয়ে। ঘরোয়া বিবাদ কিনা বলা মুশকিল, তবে দুটি বাড়িই তৈরি করেছিল আমেরিকান সৈন্যরা। শহরবাসীর বাঁচার জন্য নয়, বেগিচের জন্ম হয়েছিল সেনাবাহিনীর গোপন কার্যালয় ও অস্ত্রভাণ্ডার রূপে। সেটা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়। পরে ঠিক হয় এখানে ইউ.এস আর্মির ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ খোলা হবে। ১৯৫৩ সালে শুরু হয় দশটি টাওয়ার তৈরির কাজ। বেগিচের প্রথম নাম ছিল হজ বিল্ডিং। কিন্তু বছরে তিন-চার মাস মাত্র সুগম থাকে হুইটিয়েরের পথ। বাকি সময় যাতায়াত করতে হয় একটা টানেলের মধ্যে দিয়ে। এই অবস্থায় কোনো বড়োমাপের সরকারি পরিকল্পনা চালানো মুশকিল। শেষ পর্যন্ত বন্ধ করে দিতে হয় সেই পরিকল্পনা।
১৯৬০-এ হজ ও ১৯৬৬-তে বাকনার বিল্ডিং-কে শূন্য রেখে চলে যায় সেনাবাহিনী। এর মধ্যে ১৯৬৪-তে এক ভয়ংকর ভূমিকম্প ও বন্যা হয় সেখানে। প্রাণ বাঁচাতে শহরের সাধারণ মানুষ উঠে আসেন হজ বিল্ডিংয়ে। সেই শুরু, ক্রমে সেটাই হয়ে ওঠে তাদের বাসস্থান। ১৯৭২-এ আলাস্কার এক নিখোঁজ রাজনৈতিক নেতার নাম অনুসারে, এর পরিবর্তিত নাম হয় বেগিচ। ২০১৬-তে একবার শুধু মেরামতির কাজ করতে হয় এখানে, নয়তো প্রায় সত্তর বছর পরেও দিব্যি শক্তপোক্ত আছে বাড়িটি।
আরও পড়ুন
যুদ্ধে নিখোঁজদের সাইকেল দিয়ে মনে রাখে মেসির শহর
ঠিক কী কী আছে এর ভিতরে? একতলায় ঢুকলেই চোখে পড়বে একটি থানা। পাশেই রয়েছে পোস্ট অফিস। প্রশাসনিক কাজকর্মের জন্য নির্ধারিত অফিসগুলিও রয়েছে এই তলাতেই। এছাড়াও আছে একটি বিরাট দোকান। সারা বছরের জন্য দরকারি সমস্ত সামগ্রী পাওয়া যায় এখান থেকে। দোতলায় রয়েছে হাসপাতাল এবং একটি চার্চ। ‘হুইটিয়ের স্কুল’-টি অবশ্য বাড়ির বাইরে, তবে মাটির তলার বিশেষ সুড়ঙ্গের মধ্যে দিয়ে যাতায়াত করা যায় অনায়াসে। আছে বাচ্চাদের খেলাধুলোর জন্য একটি কৃত্রিম মাঠও। মোট কথা একটি ছোটো শহরের যা যা প্রয়োজন, সবই আছে এই বাড়ির মধ্যে।
আরও পড়ুন
ব্যস্ত শহরের মধ্যেই ছিল পারমাণবিক চুল্লি, জানতেন না কেউই
একসঙ্গে থাকার কারণে প্রত্যেকেই একে-অপরকে চেনে। শুভ অনুষ্ঠানে নিমন্ত্রণ থাকে সবার। যখন তখন দরজায় কড়া নাড়ানো যায় পুলিশের ঘরে। কিংবা পড়া বুঝতে চলে যাওয়া যায় শিক্ষক-শিক্ষিকার কাছে। মনোমালিন্য হয় নিজেদের মধ্যে, তবে জীবনের তাগিদেই পাশে এসে দাঁড়াতে হয় বিপদকালে। বাইরে দুরন্ত প্রকৃতি, আর ভিতরে লড়াই চলছে মানুষের। এর মধ্যে বিবাদ বাঁধলে ক্ষতি আখেরে নিজেদেরই। ফলে এভাবেই সুখে-দুঃখে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে রয়েছে ২০০ জন বেগিচ-বাসীর একান্নবর্তী পরিবার।
Powered by Froala Editor