বিশ শতকের গোড়ার দিক। স্বাধীনতা আন্দোলন, প্রতিবাদের আগুনকে ঠাকাতে বাংলার বুকে বিভাজনের রাজনীতি খেলা শুরু করে দিয়েছে ব্রিটিশ সরকার। সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা লাগানোর পরিকল্পনায় বঙ্গভঙ্গের নীল-নকশা প্রস্তুত করে ফেলেছেন লর্ড কার্জন। তবে আশ্চর্যের বিষয়, এই একই সময়ে দ্বিভক্ত হয়ে গিয়েছিল খোদ ব্রিটেনের রাজধানী লন্ডন (London)। এমনকি ছড়িয়ে পড়েছিল ভয়াবহ দাঙ্গা (Riot)। আর সেই দাঙ্গার কেন্দ্রবিন্দু ছিল একটি পথ-কুকুর।
হ্যাঁ, ঠিকই পড়েছেন। কুকুর (Street Dog)। বিস্ময়কর হলেও এমন ঘটনাই ঘটেছিল ব্রিটেনে (Britain)। রাস্তার একটি কুকুরের মৃত্যু নিয়েই সেবার ধুন্ধুমার লেগেছিল লন্ডনের বুকে। প্রায় ৭ বছর ধরে অব্যাহত ছিল সেই দাঙ্গার আবহ। কিন্তু কী এমন ঘটেছিল দাঙ্গা লাগার মতো? শুরু থেকেই বলা যাক সেই গল্প।
১৯০৩ সালের ২ ফেব্রুয়ারি। লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ে চিকিৎসাবিজ্ঞানের ছাত্রদের নিয়ে একটি বিশেষ সেমিনারের আয়োজন করেছিলেন কিংবদন্তি গবেষক ও ফিজিশিয়ান ডঃ উইলিয়াম বেইলিস। যিনি হরমোনের সহকারী আবিষ্কর্তাও বটে। সে যাই হোক, সেদিন লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ে আয়োজিত সেই সেমিনারের মূল বিষয় ছিল লিঙ্গুয়াল নার্ভের গঠন এবং লালাগ্রন্থি সংক্রান্ত রোগের মূল্যায়ন। আর লালাগ্রন্থি অস্ত্রোপচারের ডেমনস্ট্রেশনের জন্যই বেইলিস বেছে নিয়েছিলেন ‘ব্রাউনি’ নামের পথ-কুকুরটিকে।
গবেষণার জন্য অন্যান্য প্রজাতির ওপর পরীক্ষামূলক অস্ত্রোপচার নতুন কিছু নয়। এমনকি এই ঘটনার মাত্র মাস দুয়েক আগেই ব্রাউনির ওপরে একই ধরনের পরীক্ষা চালিয়েছিলেন আরেক গবেষক আর্নেস্ট স্টারলিং। তবে বিতর্কের সূত্রপাত হয় লন্ডনের সেই সেমিনারেই। সেদিন মেডিক্যাল শিক্ষার্থীদের ভিড়ে পরিচয় গোপন করে মিশে ছিলেন দুই সুইডিস প্রাণী অধিকারকর্মী লিজি লিন্ড এবং লিজা শারটাউ।
আরও পড়ুন
দাঙ্গাবাজদের মুখোমুখি সুনীল গাভাসকার, একাই বাঁচালেন একটি পরিবারকে
কর্মশালার প্রথম পর্যায় বেশ সফলভাবেই উতরে গিয়েছিলেন বেইলিস। বিপত্তি বাঁধে তার ঠিক পরেই। বেইলিসের ছাত্র ও ভবিষ্যৎ নোবেলজয়ী হেনরি ড্যালে ভুলবশত প্যানক্রিয়াস অপসারণ করতে গিয়ে ছুরি চালিয়ে ফেলেন ব্রাউনির হৃদপিণ্ডে। ঘটনাস্থলেই মৃত্যু হয় কুকুরটির।
আরও পড়ুন
দেশভাগের দাঙ্গায় হারালেন বাবাকে, প্রাণ বাঁচানোর দৌড়ই যেন বদলে গেল পদকজয়ে
গবেষণার স্বার্থে প্রাণীদের ওপর নৃশংসতা নিয়ে দীর্ঘদিন ধরেই প্রতিবাদ ও বিক্ষোভ চলে আসছিল লন্ডনে। সেই বিক্ষোভেই যেন ঘৃতাহুতি দেয় ব্রাউনির মৃত্যু। ভিভিসেকশনের ঘটনা সামনে থেকে প্রত্যক্ষ করার অভিজ্ঞতা সামনে আনেন সুইডিস অধিকারকর্মী লিজি ও লিজা। দাবি করেন, ব্রাউনি সম্পূর্ণভাবে অবচেতন হওয়ার আগেই অস্ত্রোপচার করেছিলেন উইলিয়াম বেইলিস। পাশাপাশি অস্ত্রোপচারের ভার অদক্ষ ছাত্রের হাতে তুলে দিয়েছিলেন তিনি। তাঁদের এই অভিযোগই রীতিমতো সাড়া ফেলে দেয় লন্ডনের বুকে। প্রথম সারির পত্রপত্রিকাতেও নিয়মিত ছাপা হতে থাকে ‘বিজ্ঞানের নামে ঘটে চলা নৃশংসতা’-র কথা। ট্রাফালগার স্কোয়ারে ধারাবাহিকভাবে সেসময় আয়োজিত হত প্রতিবাদ মিছিল। মামলা গড়ায় আদালত পর্যন্ত। তবে শেষ পর্যন্ত সেই রায় যায় গবেষকদের পক্ষেই।
আদালতে অধিকারকর্মীদের এই পরাজয়ই উত্তপ্ত করে তোলে পরিস্থিতি। বিদ্বেষ বাড়তে এমন পর্যায়ে পৌঁছায় যে, লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়েও রীতিমতো চড়াও হন বিক্ষোভকারীরা। আক্রান্ত হন বেশ কিছু ছাত্রছাত্রী। ক্ষতিগ্রস্ত হয় গবেষণাগারও। অন্যদিকে লন্ডনের বুকে তখন ব্রাউনির নামে স্মৃতিসৌধ স্থাপনের জন্য অর্থসংগ্রহ চলছে। বছর খানেকের মধ্যেই স্থাপিত হয় ব্রাউনির ব্রোঞ্জের মূর্তি। বসানো হয় একটি স্মৃতিফলকও। সেই স্মৃতিফলকের বক্তব্যই আরও উস্কে দেয় বিতর্ক। ব্যাটারসি পার্কের মূর্তিটি চিকিৎসাবিদ্যার ছাত্রদের আক্রমণের শিকার হওয়ায়, একতরফা বিক্ষোভ দাঙ্গার চেহারা নেয়। যা চলেছিল প্রায় ৫ বছরেরও বেশি সময় ধরে।
গোটা পরিস্থিতি হানাহানির পর্যায়ে চলে যাওয়ার পর, হস্তক্ষেপ করতে বাধ্য হয় লন্ডন প্রশাসন। ১৯১০ সালে তৈরি হয় ব্যাটারসি কাউন্সিল। সেই কাউন্সিলই গোটা ঘটনার পর্যালোচনা করে ব্রাউনির মূর্তিটি সরিয়ে ফেলার নির্দেশ দেয়। স্বাভাবিকভাবেই তাতে সায় ছিল না বিক্ষোভকারীদের। শেষ পর্যন্ত রাতের অন্ধকারে সরিয়ে নিয়ে গিয়ে গলিয়ে ফেলা হয় ব্রোঞ্জের মূর্তিটি।
এর সাত দশক পর আরও একবার চর্চায় উঠে এসেছিল ‘ব্রাউনি-হত্যা’-র ইতিহাস। তবে সেবার আর নৃশংস চেহারা নেয়নি পরিস্থিতি। ১৯৮৫ সালে, মূর্তিধ্বংসের ৭৫ বছর পূর্তিতে পুনরায় একটি মূর্তি প্রতিষ্ঠা করা হয় ব্যাটারসি পার্কে। আজও অক্ষত অবস্থাতেই দাঁড়িয়ে রয়েছে সেই মূর্তি। তবে ব্রিটেনের তরুণ প্রজন্মের অধিকাংশের কাছে অপরিচিত ইতিহাসের এই অন্ধকার অধ্যায়। তবে শতাব্দী পেরিয়ে এসেও কি এতটুকু বদলেছে পরিস্থিতি? কুকুরের ওপর না হলেও, গবেষণাগারে এখনও সমানভাবেই পরীক্ষানিরীক্ষা চলে অন্যান্য প্রজাতির প্রাণীদের ওপর। অবশ্য সেই গবেষণার সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে মানুষের অস্তিত্ব রক্ষার লড়াই-ও। কিন্তু ভিভিসেকশন আদৌ কতটা নৈতিক— তা নিয়ে তর্কের অবকাশ তো থেকেই যায়…
তথ্যসূত্রঃ
১. How the cruel death of a little stray dog led to riots in 1900s Britain, The Guardian
২. The Brown Dog Affair, Wikipedia
Powered by Froala Editor